সোমবার, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১২

মুক্তমনা নি-ধার্মিকদের সামাজিক সমস্যাঃ প্রতিকারের ভাবনা


আমাদের দেশে প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য মুক্তমনা নিধার্মীকদের সংখ্যা কম নয়। বহু পূর্ব থেকে বিশেষ করে বাঙ্গালি রেনেসাঁর পর থেকে জ্ঞানের সর্বক্ষেত্রে যুক্তিবাদী, বস্তুবাদী, চিন্তা চেতনা এবং বিজ্ঞান ও মুক্তবুদ্ধির চর্চা শুরু হয়, পাশাপাশি সমাজে মুক্তমনা নিধার্মীকদের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। বিভিন্ন ধর্মীয় সংস্কার যেমন বিধবা বিবাহের প্রচলন, বাল্য বিবাহ ও বহু বিবাহে প্রতিবন্ধকতা, বিভিন্ন সামাজিক কুসংস্কার দূরীকরণ, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ধর্ম নিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রচলন ইত্যাদি প্রগতিশীল সংস্কারের পেছনে মুক্তমনা মনিষীদের অবদান রয়েছে ব্যাপক। বর্তমানেও সামাজিক ও রাজনৈতিক পশ্চাৎপদ যে কোন ইস্যুতে মুক্তমনা নি-ধার্মিক বুদ্ধিজীবীগণ ধারাবাহিকভাবে তাদের বক্তব্য তুলে ধরছেন। বিভিন্ন প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে মুক্তমনা নি-ধার্মিক কর্মীদের অবদান যথেষ্ট। আধুনিক প্রযুক্তির যুগে ইন্টারনেট মুক্তবুদ্ধির চর্চার ক্ষেত্রে এক বিরাট ভূমিকা পালন করে চলছে। বিশেষ করে ইন্টারনেট তরুণ প্রজন্মের সামনে জ্ঞান, বিজ্ঞান ও যুক্তির এক বিরাট দ্বার খুলে দিয়েছে। বিদেশী বিভিন্ন সাইট তো বটেই এমনকি দেশীয় এমন কিছু সাইট রয়েছে যেগুলো তরুণ সমাজের উপর মুক্তবুদ্ধি চর্চার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করছে। ব্লগিয় তর্ক বিতর্ক উন্মুক্ত করে দিচ্ছে ভাববাদী জড়বুদ্ধিতা। সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটছে নি-ধার্মিক মুক্তমনার।
এই বৃদ্ধি তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে সদা প্রবহমান থাকবে এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু নি-ধার্মিকতার কারণে মুক্তমনাদের সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনে প্রতিনিয়ত যে প্রতিকূলতার সন্মুক্ষীণ হতে হচ্ছে সেদিকে এখনো কোন দৃষ্টিপাত বা প্রতিকারের কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। নতুন প্রজন্মের গায়ে হয়তো প্রতিকূলতার ছাপ সেভাবে পড়েনি কিন্তু প্রবীণ মুক্তমনাদের অবশ্যই সেগুলোর মোকাবেলা করতে হচ্ছে।
আমাদের দেশে প্রবীণ অনেক মুক্তমনাই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ইস্যুতে ধর্মীয় মৌলবাদীদের হুমকি এমনকি হামলার শিকার হয়েছেন। তাদের স্বাধীন মতামত দেয়ার অধিকার বিভিন্ন সময়ে খর্ব করা হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে অনেকে হয়ে পরেছেন কোণঠাসা। রাজনৈতিক এই ধরণের প্রতিকূলতা তো রয়েছেই। সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনে অনেকে ছিলেন জন বিচ্ছিন্ন বা নিঃসঙ্গ। সামাজিক অনেক আচার অনুষ্ঠানে তারা ধর্মীয় কারণে অংশ গ্রহণ করতে পারেন না। আত্মীয়তা বজায় রাখা তাদের পক্ষে হয়ে পরে কঠিন। সম মানসিকতার জীবন সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে মুক্তমনাদের সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই পারিবারিক ক্ষেত্রেও অনেক সময় ঐকমত থাকে না। সামাজিক কারণে এমন অনেক ধর্মীয় অনুশাসন মেনে নিতে হয় যেগুলোতে তিনি একমত নন। নিজের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে তাকে প্রতি পদে পদে আপোষ করে চলতে হয়। মুক্তমনা পরিবারের সন্তানরা বিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষা নিতে বাধ্য হচ্ছে, কারণ ধর্মীয় বিষয়ের বিপরীতে নি-ধার্মিক পরিবারের সন্তানদের জন্য কোন বিজ্ঞান ভিত্তিক বিষয় অথবা সমাজের সকল ধর্মের পরিচয়মূলক কোন বিষয়  পাঠ্যতালিকায় নেই। ছোটবেলা থেকেই শিক্ষাঙ্গনে শিশুদের ধর্মের ভিত্তিতে পৃথক করে ফেলা হচ্ছে যা মুক্তমনা অভিভাবকদের পক্ষে মেনে নেয়া কষ্টকর। জীবিত অবস্থায় এধরনের হাজারো সমস্যার মধ্য দিয়ে পার হলেও মৃত্যুর পর সৎকার নিয়ে আত্মীয় স্বজনদের পড়তে হয় এক বিব্রতর অবস্থায়। কয়েকজন নি-ধার্মিক মুক্তমনা বিজ্ঞানের কাজে নিজের দেহকে মেডিকেল ছাত্রদের জন্য দান করে গেলেও অধিকাংশ মুক্তমনাদের ক্ষেত্রে সে সুযোগ হয়না। মুক্তমনাদের সমন্বিত এমন কোন প্রচেষ্টাও নেই যাতে করে নিজেদের কোন সমাধিক্ষেত্রের ব্যবস্থা করা যায় এবং নিজেদের ব্যবস্থাপনায় সমাধিস্থ করা যায়।
 এ ধরনের বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা থাকা স্বত্বেও এখন পর্যন্ত নি-ধার্মিক মুক্তমনাদের প্রতিকারের ব্যাপারে কেমন যেন উদাসীন মনে হয়। এর পেছনে বেশ কিছু মানসিক সমস্যা কাজ করতে পারে। আমাদের দেশে বস্তুবাদী দর্শনের পথিকৃৎ যারা ছিলেন তাদের অধিকাংশই যুক্ত ছিলেন মার্ক্সবাদী রাজনীতির সাথে। তারা ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকলেও নিজেদের নাস্তিকতার পরিচয় জনসম্মুখে প্রকাশ করতেন না। তারা মনে করতেন এই সমাজে পৃথক ভাবে নি-ধার্মিক নাগরিকদের অধিকার আদায়ের কোন প্রয়োজন নেই কারণ রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তন ঘটলে নি-ধার্মিক মুক্তমনারাও তাদের সামাজিক ভিত্তি খুঁজে পাবে। তাই জন-বিচ্ছিন্ন হওয়ার ভয়ে তারা ধর্মীয় বিষয়গুলোকে ভবিষ্যতের জন্য তুলে রাখতেন। অনেক বুদ্ধিজীবী নি-ধার্মিক তাত্ত্বিকভাবে নাস্তিক হলেও নিজের পারিবারিক ধর্মীয় সমাজের সদস্য হিসেবে থাকতেই পছন্দ করেন। এর দুটি সুবিধা রয়েছে। এর ফলে একদিকে যেমন একটি বৃহত্তর সমাজের সুবিধা ও নিরাপত্তা ভোগ করা যাচ্ছে, অপরদিকে সমাজে নিজেকে একজন প্রগতিশীল আধুনিক মানুষ হিসেবেও জাহির করা যাচ্ছে। নাস্তিক নন কিন্তু ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে এরূপ ব্যক্তির সাথে উপরোক্ত বুদ্ধিজীবীর একটি মিল রয়েছে। তারা উভয়েই একটি নিরাপদ অবস্থানে থেকে নিজ ধর্মের সমালোচনা করতে পারেন এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ধর্মের সংস্কারও করতে পারেন। এক্ষেত্রে নাস্তিক বুদ্ধিজীবী হলেন একজন হিপোক্রেট এবং গোঁড়ামি মুক্ত ধার্মিক ব্যক্তিটি হলেন সৎ সংস্কারক।
আবার অনেক নি-ধার্মিক মুক্তমনা রয়েছেন যারা বিভিন্ন ধর্মের অযৌক্তিক বিষয়গুলো নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে সমালোচনা করে যাচ্ছেন। তারা মনে করেন এভাবে সমালোচনা করার মাধ্যমে সমাজ থেকে ধর্মীয় কুসংস্কার দূর করা যাবে। কিন্তু এভাবে অন্য ধর্মের সমালোচনা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নীতিকে ব্যাহত করে। এমন কি যার যার বিশ্বাস অনুযায়ী ধর্ম পালনের অধিকারের প্রশ্নটিও এতে বিঘ্নিত হয়। এ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোন ধর্মীয় বিশ্বাসকে আঘাত না করে সাধারণভাবে ভাববাদী দর্শনের সমালোচনা করা যেতে পারে এবং ধারাবাহিকভাবে বিশ্ব সৃষ্টির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ও বিবর্তনবাদের সাম্প্রতিক আবিষ্কারগুলোকে তুলে ধরা যেতে পারে।  কারণ একজন নি-ধার্মিক মুক্তমনা কোন ধর্ম সংস্কারক নন বরং তিনি একজন যুক্তিবাদী বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাকারী হতে পারেন। একটি পৃথক নি-ধার্মিক মুক্তমনা সমাজের সদস্য হয়ে মুক্তবুদ্ধির চর্চা করা এবং সে অনুযায়ী সামাজিক জীবনাচরণ পরিচালনা করাই হবে একজন দার্শনিক বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি সৎ নি-ধার্মিক মুক্তমনার সঠিক পথ।
একজন নি-ধার্মিক মুক্তমনাকে যদি তার দার্শনিক বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির কাছে সৎ থাকতে হয় তাহলে তাকে অবশ্যই বাস্তব জীবনাচরণেও ধর্ম মুক্ত থাকতে হবে। এজন্য তাকে অবশ্যই তার পারিবারিক ধর্মীয় সমাজের সাথে নাড়ী ছিন্ন করে নি-ধার্মিক মুক্তমনাদের নিজস্ব সমাজে অন্তর্ভুক্ত হতে হবে।
একটি ধর্ম নিরপেক্ষ দেশে সকল নাগরিক শান্তিপূর্ণ ভাবে স্ব স্ব ধর্ম পালন করে যাবে, প্রয়োজন হলে ধর্মীয় সংস্কারের জন্য নিজ নিজ ধর্মের সমালোচনা করবে, এটাই স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। একই ভাবে নি-ধার্মিক মুক্তমনারাও তাদের নিজস্ব সমাজে নি-ধার্মিক সামাজিক জীবনাচরণ করবে এবং তাদের যুক্তিবাদী মতামত প্রচার করবে, এতে আর অস্বাভাবিকত্ব কোথায়? এবং সেটাই করা উচিৎ।
২০/২/২০১২    

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন