ভ্রমণে বেড়িয়েছি অগাস্ট মাসের তিন তারিখে। ঘুরাঘুরির জন্য এটা যথাযথ সময় নয়। দেশে থাকতেই সুহ্রিদরা সাবধান করেছিল এই ঋতুতে প্রচন্ড গরমের জন্য কলকাতা ঘুরতে পাড়ব না। কিন্তু উপায় ছিল না। রোজা ঈদ পূজা মিলিয়ে এসময় বেশ বড় একটি ছুটি ছিল। এই সময়ের বাইরে আগামী দুই বছরের জন্য আর কোন ফাঁক নেই। তাই এটাই আমাদের জন্য মোক্ষম সময়। তাছাড়া রোজা ঈদ পূজা আমাদের মত নাস্তিক পরিবারের জন্য কোন সমস্যার কারণ ছিল না। বরং ভাবলাম এসময় পর্যটকদের ভিড় একটু কমই থাকতে পারে। কিন্তু আমার এ ধারণা সঠিক ছিল না। ঈদ পার্বণেই নাকি বাংলাদেশের এক শ্রেণীর লোকেরা কেনাকাটার জন্য কলকাতা, সিংগাপুর, দুবাই যাতায়াত করে থাকে। তাই ভিসা পাওয়ার পরদিনই বেড়িয়ে পরার ইচ্ছা থাকলেও বাসের টিকিট পেলাম তিন দিন পরের। রাত এগারটায় কল্যাণপুর থেকে বাস ছেড়ে সকাল আটটায় বেনাপোল নামিয়ে দিল। এসি বাস। সারারাত আরামে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলাম। সকালের দিকে বাংলাদেশের ভাগে জানালা দিয়ে যেরকম অভ্যস্ত গ্রামীণ দৃশ্যগুলো দেখেছি, সীমান্ত পার হবার পর সেই দৃশ্যপট কিছুটা পালটে গেল। বাংলাদেশের ভাগে যশোর রোড মোটামুটি প্রসস্ত, দুই লেন, নোতুন। রাস্তার দুপাশ গাছ বিহীন পরিস্কার। রাস্তার উপর সেরকম দোকান পাটও নেই। সীমান্ত দ্বারে বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন কার্য্যালয়টি যাত্রীদের সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন একটি আধুনিক স্থাপত্যের সুন্দর দ্বিতল ভবন। পাশে এরচেয়ে বড় আর একটি ভবণ নির্মান হচ্ছে। ভারতের দিকের কার্য্যালয় বলতে রঙচটা হীন কয়েকটি বিচ্ছিন্ন একতালা কক্ষসমষ্টি। অধিকাংশ সময় যাত্রীদের ঝড় বাদলে বাইরে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
পাবলিক বিল্ডিং বলে একধরণের ভবন রয়েছে যেখানে জনগনকে বিভিন্ন সার্ভিস দেয়া হয়। জনগনের পয়সায় সেগুলো তৈরি করা হয়। জনগনই সেই ভবনের কর্মচারীদের বেতনের টাকা যোগায়। সার্ভিসের চাহিদা অনুযায়ী সে সমস্ত ভবনে থাকবে যথেষ্ট পরিসরের লাউঞ্জ এবং শৌচাগারের মত সুবিধাদি। যেখানে সকলেই যেন অপেক্ষা করতে পারে। কিন্তু আমাদের এবং আমাদের মত প্রাক উপনিবাসিক দেশে পাবলিক ভবন হোল জমিদারী আমলের কাচারি ঘরের মত। যার সামনে প্রজারা খাজনা পরিশোধ করবে বলে করজোড়ে অপেক্ষা করে থাকে। নায়েবদের রক্ত চক্ষুর সামনে যারা নিতান্তই অসহায়। এমনকি উন্নত দেশগুলি তাদের নিজেদের নাগরিকদের সন্মান দিলেও আমাদের দেশে দূতাবাসগুলোতে আমাদের সাথে একই নায়েবী আচরণ করে থাকে!
আচার আচরণে স্বভাব চরিত্রে নায়েব প্রজার ঐতিহ্য ধরে রাখলেও নায়েবি আমলের ঐতিহাসিক নিদর্শণগুলো মুছে ফেলতে আমরা খুবই আগ্রহী। যশোর রোডটি সেই নবাবী আমলের রোড। ভারত বাংলাদেশের দুদিকেই এই ঐতিহ্যবাহী মহাসড়কের দুধারে শতবর্ষ বয়সী শিরিষ, মেহগনি, শাল গাছ গুলো দীর্ঘদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল।

ছবিঃ কৌসিক
এমন কি এই গাছের সাড়িগুলো আমরা কয়েক দশক পূর্বেও সাভার হয়ে ঢাকা পর্যন্ত বিস্তৃত দেখেছিলাম। বাংলাদেশের দিকে অপরিকল্পিত ভাবে রাস্তা উন্নয়ন করে এই গাছগুলোকে কেটে ফেলা হয়েছে। ভারতের দিকে এই গাছগুলো রক্ষার একটা প্রচেষ্টা চলছে। তারা রাস্তা গাছ কেটে দুদিকে না বাড়িয়ে একপাশের গাছের সারি মাঝখানে আইল্যান্ডে রেখে পাশে সুম্পূর্ন নূতন আর একটি রাস্তা করছে।
বেনাপোল থেকে কলকাতা বাসে দুই ঘন্টার পথ কিন্তু সময় নেয় চার ঘন্টা। কারণ অপ্রসস্ত রাস্তায় স্পীড উঠানো যায় না। তাছাড়া রাস্তার দুধারে প্রায়ই দোকান পাট, বাজার, মানুষের জীবন প্রবাহ রাস্তায় মানুষের ভীড় করে রেখেছে। যেখানে বাংলাদেশের অংশে রাস্তার দুধারে সবুজ ফসলের ক্ষেত দৃষ্টিকে প্রসারিত করে রেখেছিলো। এদিকে পূরানো পূরানো ঘর বাড়ি, দোকান পাট, বাজার, মফঃস্বল শহর রাস্তাটিকে সচল করে রেখেছে। দুদিকের দৃশ্যপটের পার্থক্য খুঁটিয়ে দেখলে বেশ চোখে পরার মত। বাংলাদেশ পার হলেই বিলবোর্ডের লেখাগুলো বেশ চোখে বাজে। ফন্টগুলো পূরানো ধাঁচের। রঙের ব্যবহার ও ডিজাইনে নতুনত্ব নেই। দোকানগুলো ছোট ছোট, অনেক দোকানদারই খালি গায়ে বসে আছে। এদিককার একতলা বাড়ী ঘরে এখনো বেশ টালির ব্যবহার রয়েছে। দশ বার ফিট অপ্রসস্ত বাড়ীগুলো পেছনের দিকে লম্বা হয়ে গেছে। সামনের অংশ প্রায়ই দোকান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ভবণগুলোর বারান্দায় কোন ড্রপ নেই। ফলে কাঠামো বেড়িয়ে থাকায় দেখতে ভাল দেখায় না। ফাঁকে ফাঁকে গ্রামের অংশে প্রায়ই পাটক্ষেত চোখে পরল। মনে হয় কৃষকেরা পাটের ভাল দাম পায়। কিন্তু আমাদের ওদিকে পাটের চাষ নাই বললেই চলে।
আমাদের বাসটি কলকাতায় প্রবেশ করলো দম দম এয়ারপোর্টের পিছন সীমানা দিয়ে। রাস্তার দুপাশে আগাছায় পূর্ন খোলা নর্দমা। প্রায় বেশ কিছুক্ষণ ধরে এই রাস্তা পার হতে হয়। একটি ঐতীহ্যবাহী শহরের অভ্যর্থনা পথটি মোটেই সুখকর নয়। হতে পারে আমাদের বাসটি সেই পথ ধরে যায়নি। কারণ কলকাতা শহরটিতে জালিকার ন্যায় অসংখ্য ক্রস রোড বিছানো। ঢাকার মত এটা শুধু তিনটি রোড দ্বারা সংযুক্ত নয়। ফলে কোন গন্তব্যে যাওয়ার অনেক বিকল্প রয়েছে, আপনি আপনার সুবিধা মত যে কোন পথে যেতে পারেন। দম দম থেকে ধর্মতলা বাসে প্রায় দুই ঘন্টার পথ। নতুন পূরানো রাস্তায় মানুষ ও যানবাহন উপচে পরছে না। কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা। বিল্ডিংগুলো চার পাঁচ তলার বেশি নয়।
বেশির ভাগই সাধারণ মানের। তবে পুরানো শহরে এলে একটা এরিস্টোক্রেসি অনুভব করা যায়। দুধারে প্রশস্ত ফুটপাথ ও রাস্তা ফুটো ফাটাহীন কালো নিরেট পাথরের তৈরী বলে মনে হয়। বিল্ডিং, চত্বর, রাস্তা, সবকিছুই বাঁধানো এবং নতুন নির্মানাধিন ভবন নাই বলে কন ধূলো কাদা নাই। রট আয়রনের নক্সা করা রেলিংযুক্ত ঝুলন্ত বারান্দা ও সবজে নীল রঙের ঘুলঘুলি অয়ালা দরজা জানালা নিয়ে চূন পলেস্তরা ক্ষয়ে যাওয়া সারি সারি ভবনগুলো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিচিত্র ধরণের ব্যবসা ও থাকার বোর্ডিং ভবনগুলো প্রান চাঞ্চল্য করে রেখেছে। রাস্তায় সিএনজি, রিকসা নাই। তবে হলুদ ও সাদা রঙের প্রচুর এম্ব্যাসেডার গাড়ী রাস্তার দুপাশে সারিবদ্দ দাঁড়িয়ে আছে। ট্রাম লাইনে ট্রাম ও মুড়ির টিন বাসগুলো কিছুক্ষণ পর পর নিঃশব্দে আপ ডাউনে চলাচল করছে। ক্লান্ত পায়ে মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত মানুষ ফুটপাথ ধরে হেঁটে যাচ্ছে, বাসে উঠছে নামছে। টাইট জিন্সের প্যান্ট সার্ট পড়া শুকনো মেয়েরাও এই দলে আছে। এই সব দেখে দেখেই আমরা একসময় মারকুইস স্ট্রীটে পৌঁছে গিয়েছিলাম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন