জীবন থেকে আর একটি বছর হারিয়ে গেলো। আজ ২০১২ সালের প্রথম সকাল। ভোর বেলা উঠে পূব আকাশের দিকে তাকালাম। এখনো সূর্য উঠেনি। কিন্তু দিগন্তে তার আভা ছড়িয়ে আছে। কালচে নীল মেঘের ছোপ ছাপিয়ে আলোর দ্যুতি ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। সেই আলোতে জরিয়ে রয়েছে শীতের কুয়াশা। জীবনে মাত্র বাহান্ন বার পেয়েছি বছরের এমন প্রথম ভোর! গভীর রাতের ভোরে ঘুম ভেঙ্গে গিয়ে আর ঘুম আসছিলো না। বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে অর্ধ-চেতন মন কেবলই ভাবছিল এই বাহান্ন বছর জীবনে পৃথিবীতে আমার অস্তিত্ব কোথায়?
কোথাও নেই! কারণ আজ যদি আমার দেহের মৃত্যু ঘটে পৃথিবীতে আমার আর কোন অস্তিত্ব থাকবে না। অর্ধ-চেতন মনেই ভাবছিলাম, জীববিদ্যা অনুযায়ী আত্মা বলে তো কিছু নেই যা আমাকে পরকালের অনন্তকালের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আমার দেহের সমাপ্তির সাথে আমার মনেরও এখানেই সমাপ্তি।
ভাবছিলাম আমার মন তো আমার মস্তিষ্কে সর্বদা অনুরণন রত স্মৃতিগুচ্ছ ছাড়া আর কিছুই নয়। অর্থাৎ আমি হলাম আমার মস্তিষ্কে অনুরণন রত স্মৃতিগুচ্ছ। আমার মস্তিষ্কের মৃত্যু ঘটলে আমার স্মৃতিগুচ্ছও হারিয়ে যাবে যদি না এটা কোথাও কপি করে রাখি! আমার স্মৃতিগুচ্ছের তিনটি ড্রাইভ রয়েছে। একটি হল সি ড্রাইভ। যেটার স্মৃতিগুচ্ছ আমার দেহকে পরিচালনা করছে। আমার দেহের বিভিন্ন জৈব রাসায়নিক সিগনালকে গ্রহণ করছে, প্রসেস করছে এবং তারপর বিভিন্ন জৈব রাসায়নিক সিগনাল আধারে নির্দেশনা পাঠাচ্ছে। এই ড্রাইভের স্মৃতিগুচ্ছের অনুরণনের ফলে আমি সুখ, দুঃখ, ক্ষুধা, ক্ষোভ, হিংসা, বিদ্বেষ, রাগ, অনুরাগ, তাড়না, বাসনা ইত্যাদি অনুভূতিগুলো অনুভব করে থাকি, যা আমার একান্ত নিজস্ব সম্পদ। দ্বিতীয় ড্রাইভটি মনে করি ডি ড্রাইভ। এর স্মৃতিগুচ্ছে রয়েছে আমার বাইরের জগত থেকে লব্ধ জ্ঞান এবং অন্যের স্মৃতিগুচ্ছের কপি। এর দ্বারা আমি নিজেকে সব সময় আপ টু ডেট রাখি। তৃতীয় ড্রাইভের স্মৃতিগুচ্ছে থাকার কথা আমার নিজস্ব উদ্ভাবন, রচনা, বানী, আবিষ্কার, সৃষ্টি যা অন্যের কাছে প্রয়োজনীয় মনে হয় এবং যেগুলো তারা তাদের ডি ড্রাইভে কপি করে রাখে। বিশ্বের মনিষী-গন তাঁদের এই স্মৃতিগুচ্ছ স্থাপত্য, ভাস্কর্য, ক্যানভাস, পুস্তক, টেকনোলজি, হস্তশিল্প ইত্যাদিতে হার্ড কপি করে অথবা গান, কবিতা, বাণী, বচন ইত্যাদি উপায়ে বহু লোকের স্মৃতিগুচ্ছে সফট কপি করে রাখেন। এভাবে মনিষী-গন পৃথিবীতে অমর হয়ে থাকেন। কালক্রমে তাঁদের নাম কালের গর্ভে হারিয়ে গেলেও তাঁদের স্মৃতিগুচ্ছ সামাজিক মস্তিষ্কে অথবা হিউম্যান মস্তিষ্কে অথবা চূড়ান্ত রূপে জেনেটিক কোডে বেঁচে থাকে।
বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক নাকি সংরক্ষণ করা আছে। আমি জানি না মানুষের মস্তিষ্ক বাইনারী পদ্ধতিতে কাজ করে কিনা। যদি করে থাকে এবং আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের ফ্রিজ হয়ে যাওয়া স্মৃতিগুচ্ছ যদি কোনভাবে কোন কম্পিউটারে কপি করা যায় এবং সেগুলোকে যদি যথাযথ ভাবে সক্রিয় করা যায় তবে কেমন হয়? সেই কম্পিউটারটি হয়তো আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক অথবা মন হিসেবেই কাজ করবে! আত্মা বা সেলফ যদি মস্তিষ্কের স্মৃতিগুচ্ছই হয়ে থাকে তবে সেটা হবে কম্পিউটার-ধারি আইনস্টাইন। অর্থাৎ বলা যাবে আইনস্টাইন তাঁর দেহ ছেরে কম্পিউটার ধারণ করেছেন! সেই কম্পিউটার রূপি আইনস্টাইনকে যদি বর্তমান যুগের উপাত্ত সরবরাহ করা হয় তাহলে হয়তো তিনি নতুন নতুন থিওরিও আবিষ্কার করতে পারবেন। বৈজ্ঞানিক থিওরি আবিষ্কারের জন্য হয়তো দেহ জাত অনুভূতির প্রয়োজন হয় না। তাই এখানে তাঁর দেহ না থাকলেও চলবে। এমনিতেই আমরা মনিষীদের ভাবনা বা স্মৃতিকেই গ্রহণ করে থাকি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনকে নয়। মনিষীরাও তাঁদের কাজ থেকে ব্যক্তিগত জীবনকে দূরে সরিয়ে রাখেন। বর্তমান যুগের বিখ্যাত মনিষী স্টিফেন হকিংসকে তো একজন মানুষ রূপি কম্পিউটারই বলা যায়। কারণ ব্যক্তিগত অনুভূতিগুলো বাদ দিলে বহির্বিশ্বের সাথে তার যোগাযোগ ঘটে যান্ত্রিক ইনপুট আউটপুট ডিভাইস দিয়ে।
অর্ধ-চেতন ঘুমের ঘোরে আমি দেখলাম আমার তৃতীয় ড্রাইভটি একদম শূন্য। অর্থাৎ দেহান্তরের পর পৃথিবীতে রয়ে যাওয়ার কোন উপায়ই আমার নেই। একটি দেহ জাত চাপা বেদনার অনুভূতি আমার ভিতর থেকে গলায় উঠে এলো। জানি এর মূল্য কারো কাছে নেই এবং আজ বাদে কাল এর মূল্য আমার কাছেও থাকবে না। মনের ভিতরে আকুলি বিকুলি করতে করতে মনে এলো আমার একটা ফেসবুক আইডি রয়েছে! সেটাই তো ভার্চুয়াল আমি! আমার সাথে বহির্জগতের যোগাযোগ হয় এই আইডির মাধ্যমে। এই আইডির মাধ্যমেই আমার নিজস্ব ভাবনা চিন্তা অনুভূতি, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ ঘটে। আমার ঠিকানা সর্বদা নেটে বিরাজ করে। এখানে যে কেউ আমাকে দেখতে পায়, যোগাযোগ করতে পারে। আমার স্মৃতিগুচ্ছের কিছুটা এখানে সংরক্ষিত আছে। আমার দেহান্তর ঘটলেও এই ভার্চুয়াল আমিতে আমি থেকে যাব। এখন এটাকে যদি আমার সংরক্ষিত চরিত্র ও জ্ঞান অনুযায়ী এমন একটা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সে পরিণত করা যায় যে সে নিজে নিজেই বহির্জগতের সাথে নিজের মতামত আদান প্রদান করতে পারে তাহলেই কিল্লা ফতে!
নতুন বছরের ভোরে ভবিষ্যতের এই আশার আলো দেখতে পেয়ে আমি একটা স্বস্তিতে পুনরায় ঘুমিয়ে পরলাম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন