শুক্রবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১২
সোমবার, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১২
মুক্তমনা নি-ধার্মিকদের সামাজিক সমস্যাঃ প্রতিকারের ভাবনা
আমাদের দেশে প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য মুক্তমনা নিধার্মীকদের সংখ্যা কম নয়। বহু পূর্ব থেকে বিশেষ করে বাঙ্গালি রেনেসাঁর পর থেকে জ্ঞানের সর্বক্ষেত্রে যুক্তিবাদী, বস্তুবাদী, চিন্তা চেতনা এবং বিজ্ঞান ও মুক্তবুদ্ধির চর্চা শুরু হয়, পাশাপাশি সমাজে মুক্তমনা নিধার্মীকদের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। বিভিন্ন ধর্মীয় সংস্কার যেমন বিধবা বিবাহের প্রচলন, বাল্য বিবাহ ও বহু বিবাহে প্রতিবন্ধকতা, বিভিন্ন সামাজিক কুসংস্কার দূরীকরণ, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ধর্ম নিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রচলন ইত্যাদি প্রগতিশীল সংস্কারের পেছনে মুক্তমনা মনিষীদের অবদান রয়েছে ব্যাপক। বর্তমানেও সামাজিক ও রাজনৈতিক পশ্চাৎপদ যে কোন ইস্যুতে মুক্তমনা নি-ধার্মিক বুদ্ধিজীবীগণ ধারাবাহিকভাবে তাদের বক্তব্য তুলে ধরছেন। বিভিন্ন প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে মুক্তমনা নি-ধার্মিক কর্মীদের অবদান যথেষ্ট। আধুনিক প্রযুক্তির যুগে ইন্টারনেট মুক্তবুদ্ধির চর্চার ক্ষেত্রে এক বিরাট ভূমিকা পালন করে চলছে। বিশেষ করে ইন্টারনেট তরুণ প্রজন্মের সামনে জ্ঞান, বিজ্ঞান ও যুক্তির এক বিরাট দ্বার খুলে দিয়েছে। বিদেশী বিভিন্ন সাইট তো বটেই এমনকি দেশীয় এমন কিছু সাইট রয়েছে যেগুলো তরুণ সমাজের উপর মুক্তবুদ্ধি চর্চার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করছে। ব্লগিয় তর্ক বিতর্ক উন্মুক্ত করে দিচ্ছে ভাববাদী জড়বুদ্ধিতা। সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটছে নি-ধার্মিক মুক্তমনার।
এই বৃদ্ধি তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে সদা প্রবহমান থাকবে এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু নি-ধার্মিকতার কারণে মুক্তমনাদের সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনে প্রতিনিয়ত যে প্রতিকূলতার সন্মুক্ষীণ হতে হচ্ছে সেদিকে এখনো কোন দৃষ্টিপাত বা প্রতিকারের কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। নতুন প্রজন্মের গায়ে হয়তো প্রতিকূলতার ছাপ সেভাবে পড়েনি কিন্তু প্রবীণ মুক্তমনাদের অবশ্যই সেগুলোর মোকাবেলা করতে হচ্ছে।
আমাদের দেশে প্রবীণ অনেক মুক্তমনাই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ইস্যুতে ধর্মীয় মৌলবাদীদের হুমকি এমনকি হামলার শিকার হয়েছেন। তাদের স্বাধীন মতামত দেয়ার অধিকার বিভিন্ন সময়ে খর্ব করা হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে অনেকে হয়ে পরেছেন কোণঠাসা। রাজনৈতিক এই ধরণের প্রতিকূলতা তো রয়েছেই। সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনে অনেকে ছিলেন জন বিচ্ছিন্ন বা নিঃসঙ্গ। সামাজিক অনেক আচার অনুষ্ঠানে তারা ধর্মীয় কারণে অংশ গ্রহণ করতে পারেন না। আত্মীয়তা বজায় রাখা তাদের পক্ষে হয়ে পরে কঠিন। সম মানসিকতার জীবন সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে মুক্তমনাদের সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই পারিবারিক ক্ষেত্রেও অনেক সময় ঐকমত থাকে না। সামাজিক কারণে এমন অনেক ধর্মীয় অনুশাসন মেনে নিতে হয় যেগুলোতে তিনি একমত নন। নিজের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে তাকে প্রতি পদে পদে আপোষ করে চলতে হয়। মুক্তমনা পরিবারের সন্তানরা বিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষা নিতে বাধ্য হচ্ছে, কারণ ধর্মীয় বিষয়ের বিপরীতে নি-ধার্মিক পরিবারের সন্তানদের জন্য কোন বিজ্ঞান ভিত্তিক বিষয় অথবা সমাজের সকল ধর্মের পরিচয়মূলক কোন বিষয় পাঠ্যতালিকায় নেই। ছোটবেলা থেকেই শিক্ষাঙ্গনে শিশুদের ধর্মের ভিত্তিতে পৃথক করে ফেলা হচ্ছে যা মুক্তমনা অভিভাবকদের পক্ষে মেনে নেয়া কষ্টকর। জীবিত অবস্থায় এধরনের হাজারো সমস্যার মধ্য দিয়ে পার হলেও মৃত্যুর পর সৎকার নিয়ে আত্মীয় স্বজনদের পড়তে হয় এক বিব্রতর অবস্থায়। কয়েকজন নি-ধার্মিক মুক্তমনা বিজ্ঞানের কাজে নিজের দেহকে মেডিকেল ছাত্রদের জন্য দান করে গেলেও অধিকাংশ মুক্তমনাদের ক্ষেত্রে সে সুযোগ হয়না। মুক্তমনাদের সমন্বিত এমন কোন প্রচেষ্টাও নেই যাতে করে নিজেদের কোন সমাধিক্ষেত্রের ব্যবস্থা করা যায় এবং নিজেদের ব্যবস্থাপনায় সমাধিস্থ করা যায়।
এ ধরনের বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা থাকা স্বত্বেও এখন পর্যন্ত নি-ধার্মিক মুক্তমনাদের প্রতিকারের ব্যাপারে কেমন যেন উদাসীন মনে হয়। এর পেছনে বেশ কিছু মানসিক সমস্যা কাজ করতে পারে। আমাদের দেশে বস্তুবাদী দর্শনের পথিকৃৎ যারা ছিলেন তাদের অধিকাংশই যুক্ত ছিলেন মার্ক্সবাদী রাজনীতির সাথে। তারা ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকলেও নিজেদের নাস্তিকতার পরিচয় জনসম্মুখে প্রকাশ করতেন না। তারা মনে করতেন এই সমাজে পৃথক ভাবে নি-ধার্মিক নাগরিকদের অধিকার আদায়ের কোন প্রয়োজন নেই কারণ রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তন ঘটলে নি-ধার্মিক মুক্তমনারাও তাদের সামাজিক ভিত্তি খুঁজে পাবে। তাই জন-বিচ্ছিন্ন হওয়ার ভয়ে তারা ধর্মীয় বিষয়গুলোকে ভবিষ্যতের জন্য তুলে রাখতেন। অনেক বুদ্ধিজীবী নি-ধার্মিক তাত্ত্বিকভাবে নাস্তিক হলেও নিজের পারিবারিক ধর্মীয় সমাজের সদস্য হিসেবে থাকতেই পছন্দ করেন। এর দুটি সুবিধা রয়েছে। এর ফলে একদিকে যেমন একটি বৃহত্তর সমাজের সুবিধা ও নিরাপত্তা ভোগ করা যাচ্ছে, অপরদিকে সমাজে নিজেকে একজন প্রগতিশীল আধুনিক মানুষ হিসেবেও জাহির করা যাচ্ছে। নাস্তিক নন কিন্তু ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে এরূপ ব্যক্তির সাথে উপরোক্ত বুদ্ধিজীবীর একটি মিল রয়েছে। তারা উভয়েই একটি নিরাপদ অবস্থানে থেকে নিজ ধর্মের সমালোচনা করতে পারেন এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ধর্মের সংস্কারও করতে পারেন। এক্ষেত্রে নাস্তিক বুদ্ধিজীবী হলেন একজন হিপোক্রেট এবং গোঁড়ামি মুক্ত ধার্মিক ব্যক্তিটি হলেন সৎ সংস্কারক।
আবার অনেক নি-ধার্মিক মুক্তমনা রয়েছেন যারা বিভিন্ন ধর্মের অযৌক্তিক বিষয়গুলো নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে সমালোচনা করে যাচ্ছেন। তারা মনে করেন এভাবে সমালোচনা করার মাধ্যমে সমাজ থেকে ধর্মীয় কুসংস্কার দূর করা যাবে। কিন্তু এভাবে অন্য ধর্মের সমালোচনা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নীতিকে ব্যাহত করে। এমন কি যার যার বিশ্বাস অনুযায়ী ধর্ম পালনের অধিকারের প্রশ্নটিও এতে বিঘ্নিত হয়। এ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোন ধর্মীয় বিশ্বাসকে আঘাত না করে সাধারণভাবে ভাববাদী দর্শনের সমালোচনা করা যেতে পারে এবং ধারাবাহিকভাবে বিশ্ব সৃষ্টির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ও বিবর্তনবাদের সাম্প্রতিক আবিষ্কারগুলোকে তুলে ধরা যেতে পারে। কারণ একজন নি-ধার্মিক মুক্তমনা কোন ধর্ম সংস্কারক নন বরং তিনি একজন যুক্তিবাদী বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাকারী হতে পারেন। একটি পৃথক নি-ধার্মিক মুক্তমনা সমাজের সদস্য হয়ে মুক্তবুদ্ধির চর্চা করা এবং সে অনুযায়ী সামাজিক জীবনাচরণ পরিচালনা করাই হবে একজন দার্শনিক বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি সৎ নি-ধার্মিক মুক্তমনার সঠিক পথ।
একজন নি-ধার্মিক মুক্তমনাকে যদি তার দার্শনিক বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির কাছে সৎ থাকতে হয় তাহলে তাকে অবশ্যই বাস্তব জীবনাচরণেও ধর্ম মুক্ত থাকতে হবে। এজন্য তাকে অবশ্যই তার পারিবারিক ধর্মীয় সমাজের সাথে নাড়ী ছিন্ন করে নি-ধার্মিক মুক্তমনাদের নিজস্ব সমাজে অন্তর্ভুক্ত হতে হবে।
একটি ধর্ম নিরপেক্ষ দেশে সকল নাগরিক শান্তিপূর্ণ ভাবে স্ব স্ব ধর্ম পালন করে যাবে, প্রয়োজন হলে ধর্মীয় সংস্কারের জন্য নিজ নিজ ধর্মের সমালোচনা করবে, এটাই স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। একই ভাবে নি-ধার্মিক মুক্তমনারাও তাদের নিজস্ব সমাজে নি-ধার্মিক সামাজিক জীবনাচরণ করবে এবং তাদের যুক্তিবাদী মতামত প্রচার করবে, এতে আর অস্বাভাবিকত্ব কোথায়? এবং সেটাই করা উচিৎ।
২০/২/২০১২
শনিবার, ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১২
আমি বিব্রত বোধ করছি: নিজ দেশে আমি যেন এক পরবাসী
আমি একজন মুক্তমনা। নির্দিষ্ট কোন ধর্মে বিশ্বাস আমার নেই। আমি বাংলাদেশের একজন সংখ্যালঘু নাগরিক। আমি আজ বিব্রত। কারণ সাম্প্রতিক কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের সংবিধানে এমন কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে, যার ফলে আমি এক ধরনের হীনমন্যতায় ভুগছি। আমার যুক্তিবাদী অনুভূতিতে আঘাত লাগার ফলে আমি প্রতিনিয়ত হচ্ছি ক্ষরিত। গণতন্ত্রের সুবিধা প্রয়োগ করে আমার সম অধিকার-বোধ খর্ব করায় আমি আমার মতামত প্রকাশেও ভয় পাচ্ছি।
বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষ সক্রিয় অংশগ্রহণ, সহযোগিতা, সমর্থন ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র লাভ করেছে। সর্বস্তরের জনগণের আশা, আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন ঘিরেই রচিত হয়েছে এই বাংলাদেশ। সুতরাং ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সর্ব বিষয়ে সমাধিকার যে এখানে নিশ্চিত হবে সেটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের সংবিধানেও এর স্বীকৃতি রয়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে রয়েছে, "যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল -জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে "। এখানে মূলনীতির একটি হোল 'ধর্মনিরপেক্ষতা'।
তৃতীয় অনুচ্ছেদে রয়েছে, "আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণ-মুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে"। এখানে ধর্ম, বর্ণ, জাতি নির্বিশেষে সকল নাগরিকদের জন্য রয়েছে 'রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য' অর্থাৎ সমান অধিকারের নিশ্চয়তা।
কিন্তু সংবিধানের উপরোক্ত দুই অনুচ্ছেদে 'ধর্মনিরপেক্ষতা' এবং সমান অধিকারের কথা বলা হলেও একই প্রস্তাবনায় পক্ষপাতমূলক সংশোধন এনে সংবিধানের প্রতি সংখ্যালঘু নাগরিকদের আস্থাকে সংশয়াবিদ্ধ করা হয়েছে।
প্রথমত সংবিধানের শিরোনাম 'গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান'-এর পরেই রয়েছে একটি নির্দিষ্ট ধর্মের বাণী "বিস্মিল্লাহির-রহ্মানির রহিম / (দয়াময়, পরম দয়ালু, আল্লাহের নামে)/ পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নামে।"
প্রথম ভাগের ২ক ধারায় রয়েছে, "রাষ্ট্রধর্ম - ২ক। প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন"।
উপরোক্ত অনুচ্ছেদ দুটি স্পষ্টতই একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি পক্ষপাত দোষে দুষ্ট। কথায় আছে "বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে", আমার হয়েছে সেই দশা। সংখ্যাগুরুর দাদা-গিরির কাছে আমি আজ বিব্রত, অসহায়।
বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষ সক্রিয় অংশগ্রহণ, সহযোগিতা, সমর্থন ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র লাভ করেছে। সর্বস্তরের জনগণের আশা, আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন ঘিরেই রচিত হয়েছে এই বাংলাদেশ। সুতরাং ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সর্ব বিষয়ে সমাধিকার যে এখানে নিশ্চিত হবে সেটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের সংবিধানেও এর স্বীকৃতি রয়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে রয়েছে, "যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল -জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে "। এখানে মূলনীতির একটি হোল 'ধর্মনিরপেক্ষতা'।
তৃতীয় অনুচ্ছেদে রয়েছে, "আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণ-মুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে"। এখানে ধর্ম, বর্ণ, জাতি নির্বিশেষে সকল নাগরিকদের জন্য রয়েছে 'রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য' অর্থাৎ সমান অধিকারের নিশ্চয়তা।
কিন্তু সংবিধানের উপরোক্ত দুই অনুচ্ছেদে 'ধর্মনিরপেক্ষতা' এবং সমান অধিকারের কথা বলা হলেও একই প্রস্তাবনায় পক্ষপাতমূলক সংশোধন এনে সংবিধানের প্রতি সংখ্যালঘু নাগরিকদের আস্থাকে সংশয়াবিদ্ধ করা হয়েছে।
প্রথমত সংবিধানের শিরোনাম 'গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান'-এর পরেই রয়েছে একটি নির্দিষ্ট ধর্মের বাণী "বিস্মিল্লাহির-রহ্মানির রহিম / (দয়াময়, পরম দয়ালু, আল্লাহের নামে)/ পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নামে।"
প্রথম ভাগের ২ক ধারায় রয়েছে, "রাষ্ট্রধর্ম - ২ক। প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন"।
উপরোক্ত অনুচ্ছেদ দুটি স্পষ্টতই একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি পক্ষপাত দোষে দুষ্ট। কথায় আছে "বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে", আমার হয়েছে সেই দশা। সংখ্যাগুরুর দাদা-গিরির কাছে আমি আজ বিব্রত, অসহায়।
ফিরিয়ে দাও আমার আরণ্যক জীবন
আমি আজ বন্দী সভ্যতা নামক বেড়াজালে! লক্ষ লক্ষ বছর ধরে গড়ে উঠা আমার আরণ্যক অধিকারগুলোকে সভ্যতার নামে ছিনিয়ে নিয়েছ তুমি। আমি আজ দিশেহারা, সর্বদা ভয় ও উদ্বেগে কাটাচ্ছি দাসত্বের জীবন। আমি ভুলে গেছি আরণ্যক জীবনের উন্নত শিরের গর্বিত পদক্ষেপ। সামান্য জীবন ধারণের জন্য আমাকে আজ নতজানু হয়ে সভ্যতার কাছে কর্ম ভিক্ষা করতে হচ্ছে। আমার নিজের, পরিবারের, বাল-বাচ্চার জীবনের নিরাপত্তার জন্য আমি রুখে দাঁড়াতে পারছি না। এই অধিকার আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। আমার মেয়ের/বোনের ছিনিয়ে নেয়া আব্রু আমাকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে হচ্ছে। আমার হাতে পরিয়ে দেয়া হয়েছে 'নিজ হাতে আইন তুলে না নেয়ার' বেড়ি। তাই আজ কাপুরুষগুলো যত্র তত্র আমাকে চোখ রাঙিয়ে চলেছে। ধূর্ত কাপুরুষগুলো হয়ে দাঁড়িয়েছ আমার দণ্ড মুণ্ডের কর্তা।
সভ্যতার সমস্ত অস্ত্রগুলো আজ তাদের হাতে। আমার আরণ্যক অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে, আমাকে নিরস্ত্র করে তারা আজ আমার শাসক! অরণ্যের স্বাধীনচেতা মানব পশু থেকে আমাকে করা হয়েছে সভ্য মানুষ! সভ্যতার কারাগারে আমি সভ্য কয়েদী। আমার ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য মুছে দিয়ে আমাকে দেয়া হয়েছে সভ্যতার নাম্বার। আমার পরিচয়ের জন্য দেয়া হয়েছে আই ডি নাম্বার, এই পৃথিবীতে জন্ম লাভের দোষে আমাকে দেয়া হয়েছে জন্ম সনদ, জীবন সঙ্গী খুঁজে নেয়ার জন্য বিবাহের রেজিস্ট্রেশন নাম্বার ইত্যাদি ইত্যাদি হাজারো রকমের অনুমতি পত্র। আমার নিজের আরণ্যক অধিকার থেকে আমি নিজে একটি সুন্দর জীবন রচনা করতে পারছি না। কতগুলো ধূর্ত কাপুরুষ ক্যান্ডিডেট থেকে আমারই শাসক নির্বাচনের জন্য আমাকে দেয়া হয়েছে ভোটার আইডি। নিজের হাতে নিজেকে খুন করার অস্ত্র। এমন কি আমি কি কথা বলব কি কথা বলব না সেটাও নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। আমি কি জানব কি জানব না সেই অধিকারও নির্ধারিত।
অথচ আরণ্যক জীবনে আমাদের সবারই ছিল একই অলিখিত অধিকার। প্রথমটি হল নিজেকে, নিজের পরিবারকে, নিজের গোষ্ঠীকে রক্ষা করার অধিকার। যেহেতু আমরা নিরস্ত্র ছিলাম না সেহেতু নিজেদের রক্ষা করার সাহস ও সামর্থ্য আমাদের ছিল। কোন ধূর্ত কাপুরুষগোষ্ঠি আমাদের আক্রমণ করার সাহস করতো না। আমরা মরে যেতে রাজী ছিলাম, বশ্যতা স্বীকারে নয়। সভ্য সমাজে নিজেদের রক্ষা করার অধিকার ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। অস্ত্র দেয়া হয়েছে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, ধূর্ত


সভ্যতার সমস্ত অস্ত্রগুলো আজ তাদের হাতে। আমার আরণ্যক অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে, আমাকে নিরস্ত্র করে তারা আজ আমার শাসক! অরণ্যের স্বাধীনচেতা মানব পশু থেকে আমাকে করা হয়েছে সভ্য মানুষ! সভ্যতার কারাগারে আমি সভ্য কয়েদী। আমার ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য মুছে দিয়ে আমাকে দেয়া হয়েছে সভ্যতার নাম্বার। আমার পরিচয়ের জন্য দেয়া হয়েছে আই ডি নাম্বার, এই পৃথিবীতে জন্ম লাভের দোষে আমাকে দেয়া হয়েছে জন্ম সনদ, জীবন সঙ্গী খুঁজে নেয়ার জন্য বিবাহের রেজিস্ট্রেশন নাম্বার ইত্যাদি ইত্যাদি হাজারো রকমের অনুমতি পত্র। আমার নিজের আরণ্যক অধিকার থেকে আমি নিজে একটি সুন্দর জীবন রচনা করতে পারছি না। কতগুলো ধূর্ত কাপুরুষ ক্যান্ডিডেট থেকে আমারই শাসক নির্বাচনের জন্য আমাকে দেয়া হয়েছে ভোটার আইডি। নিজের হাতে নিজেকে খুন করার অস্ত্র। এমন কি আমি কি কথা বলব কি কথা বলব না সেটাও নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। আমি কি জানব কি জানব না সেই অধিকারও নির্ধারিত।
অথচ আরণ্যক জীবনে আমাদের সবারই ছিল একই অলিখিত অধিকার। প্রথমটি হল নিজেকে, নিজের পরিবারকে, নিজের গোষ্ঠীকে রক্ষা করার অধিকার। যেহেতু আমরা নিরস্ত্র ছিলাম না সেহেতু নিজেদের রক্ষা করার সাহস ও সামর্থ্য আমাদের ছিল। কোন ধূর্ত কাপুরুষগোষ্ঠি আমাদের আক্রমণ করার সাহস করতো না। আমরা মরে যেতে রাজী ছিলাম, বশ্যতা স্বীকারে নয়। সভ্য সমাজে নিজেদের রক্ষা করার অধিকার ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। অস্ত্র দেয়া হয়েছে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, ধূর্ত
কাপুরুষ শাসকগোষ্ঠীর নেট ওয়ার্কদের হাতে।আমরা তাদের হাতে বন্দী পশু। আমরা আজ মেরুদণ্ডহীন। মাথা তুলে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারি না। আমাদের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে তারা বলছে, তারাই নাকি আমাদের রক্ষা করার দণ্ড মুণ্ডের কর্তা। কিন্তু অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদ প্রতিহত করা হচ্ছে গুম অথবা ফায়ারের মাধ্যমে। আমাদের নিরস্ত্র করে করা হয়েছে বিচারের কাঠগড়া। যেখানে আমাকেই প্রমাণ করতে হচ্ছে যে আমি অত্যাচারিত। আর সেটা প্রমাণ করতে হলে চাই ভাল উকিল, ভাল টাকা, যা আমার হাতে নেই, রয়েছে ধূর্ত কাপুরুষদের হাতে।
লক্ষ লক্ষ বছর ধরে অরণ্যচারী আমাদের দ্বিতীয় অধিকারটি ছিল খেয়ে পরে বেঁচে থাকার অধিকার। পৃথিবীব্যপি ছিল আমাদের চারণভূমি। অরণ্য আমাদের সংগ্রহশালা। শস্যভূমিগুলো ছিল আমাদের কৃষিক্ষেত্র। এই পৃথিবীর সকল চারণভূমিতে সকলের ছিল অধিকার। আমরা বিভিন্ন গোষ্ঠীগুলো পরস্পরের চারণক্ষেত্রের অধিকার অস্বীকার করি নাই। শুধু মানুষ কেন, পৃথিবীর বুকে লালিত অরণ্য, পাহাড়, নদী, চারণভূমিগুলো সযত্নে রক্ষা করাই ছিল আমাদের ধর্ম। পৃথিবীর বুকে চড়ে বেড়ানো অসংখ্য প্রজাতির প্রাণীগুলোকে ধ্বংস করা আমাদের জন্য ছিল অধর্ম।লক্ষ লক্ষ বছর ধরে আমরা এভাবেই পাহাড়, প্রাণী, জল, অরণ্যে সহাবস্থান করেছি। সহাবস্থান করার প্রাকৃতিক মন্ত্রই ছিল আমাদের ধর্ম, আমাদের প্রাকৃতিক আইন। কিন্তু সভ্যতার মন্ত্র শুনিয়ে এক সময় ধূর্ত কাপুরুষগোষ্ঠি আমাদের অরণ্যের অধিকার কেড়ে নিলো। বলা হোল এই অরণ্য, পাহাড়, জল, এই পৃথিবীর মালিক নাকি তারা। তাদের এই অধিকার নাকি দিয়েছে আকাশচারী কোন দেবতা। আমাদের অরণ্যের সহাবস্থানের ধর্মকে বলা হোল বর্বরের ধর্ম। আমাদের দীক্ষিত করা হোল আকাশচারী দেবতার মন্ত্রে। তারা হয়ে উঠলো আমাদের মালিক, রাজা, জমিদার, শাসকগোষ্ঠী, আমাদের দণ্ড মুণ্ডের কর্তা। আমাদের অরণ্যের আইনকে বর্বরের আইন আখ্যা দিয়ে আমাদের শেখানো হোল ওদের মালিকানা রক্ষা করার আইন। খাজনা দিয়ে ওদের ভূমি ব্যবহার করার আইন। কেড়ে নেয়া হোল আমাদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের অধিকার; নিজেদের রক্ষা করার অধিকার। আমাদের মনোবল ভেঙ্গে দিয়ে আমাদের করা হোল নতজানু দাস। 
আরণ্যক জীবনে প্রকৃতিই ছিল আমাদের শিশুদের শিক্ষালয়। প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট না করে, অন্যের অধিকার খর্ব না করে প্রকৃতি থেকে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান সংগ্রহ করার এবং সেগুলোকে ধারাবাহিক উন্নয়নের হাতে কলমে শিক্ষাই ছিল আমাদের শিক্ষা। কয়েকটি পশু পাখী শিকারের জন্য তীর ধনুক বর্ষাই আমাদের জন্য যথেষ্ট ছিল। এর জন্য আমাদের কখনো বন্দুক, রাইফেল, মর্টার, কামান, এটম বোমার প্রয়োজন হয়নি।
আমাদের ছিল আরণ্যক নৈতিকতা। অরণ্যচারী অনান্য পশুদের মতই আমরা অন্য কোন প্রজাতিকে সমূলে ধ্বংস করে ফেলিনি। কিন্তু সভ্য জমানার মানুষের নৃশংসতায় অরণ্যচারী অনেক প্রজাতির প্রাণী আজ বিলুপ্ত। এমন কি উপনিবেশের নামে অনেক অঞ্চল থেকে স্থানীয় স্বজাতি মানুষকেও নির্মূল করা হয়েছে। মিথ্যাচারীতা, অসততা, ধাপ্পাবাজি, গুরুজনদের প্রতি অসম্মান, নারীদের প্রতি অসন্মান, শিশু-নির্যাতন ইত্যাদি অনৈতিক কর্ম কাণ্ড আমাদের আরণ্যক সমাজে অনুপস্থিত ছিল। আমাদের সমাজে বাল্য বিবাহ বা যৌন হয়রানি ছিল অনুপস্থিত। আমাদের যুবক যুবতীরা দৈহিক, মানসিক এবং কর্ম ক্ষমতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরই কেবলমাত্র নিজের জীবনসঙ্গী নির্বাচন করতে পারত।
নৃত্য-গীতে ভরপুর আমাদের সহজ সরল আরণ্যক জীবনের প্রাকৃতিক নিয়ম নীতিগুলো মুছে দিয়ে ধূর্ত কাপুরুষগোষ্ঠি আজ আমাদের শাসক হয়ে বসেছে। আমাদের শক্তি কেড়ে নিয়ে আমাদের নতজানু আজ্ঞাবহে পরিণত করেছে। পূর্ব-পুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং প্রকৃতির সবকিছুর সাথে সহাবস্থানের বিশ্বাসকে বিনষ্ট করে আমাদের দেয়া হয়েছে কৃত্রিম শাস্ত্র। নতজানু সভ্যতা। জন্ম লাভের পর আমি আজ আর প্রকৃতির সন্তান নই। প্রকৃতির সকলকে ভালবাসার অধিকারও আমার নেই। আমার কপালে সেটে দেয়া হয়েছে জাতীয়তা, ধর্ম ও বর্ণের তকমা। আমি এর থেকে মুক্তি চাই।
আমাদের ছিল আরণ্যক নৈতিকতা। অরণ্যচারী অনান্য পশুদের মতই আমরা অন্য কোন প্রজাতিকে সমূলে ধ্বংস করে ফেলিনি। কিন্তু সভ্য জমানার মানুষের নৃশংসতায় অরণ্যচারী অনেক প্রজাতির প্রাণী আজ বিলুপ্ত। এমন কি উপনিবেশের নামে অনেক অঞ্চল থেকে স্থানীয় স্বজাতি মানুষকেও নির্মূল করা হয়েছে। মিথ্যাচারীতা, অসততা, ধাপ্পাবাজি, গুরুজনদের প্রতি অসম্মান, নারীদের প্রতি অসন্মান, শিশু-নির্যাতন ইত্যাদি অনৈতিক কর্ম কাণ্ড আমাদের আরণ্যক সমাজে অনুপস্থিত ছিল। আমাদের সমাজে বাল্য বিবাহ বা যৌন হয়রানি ছিল অনুপস্থিত। আমাদের যুবক যুবতীরা দৈহিক, মানসিক এবং কর্ম ক্ষমতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরই কেবলমাত্র নিজের জীবনসঙ্গী নির্বাচন করতে পারত।
নৃত্য-গীতে ভরপুর আমাদের সহজ সরল আরণ্যক জীবনের প্রাকৃতিক নিয়ম নীতিগুলো মুছে দিয়ে ধূর্ত কাপুরুষগোষ্ঠি আজ আমাদের শাসক হয়ে বসেছে। আমাদের শক্তি কেড়ে নিয়ে আমাদের নতজানু আজ্ঞাবহে পরিণত করেছে। পূর্ব-পুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং প্রকৃতির সবকিছুর সাথে সহাবস্থানের বিশ্বাসকে বিনষ্ট করে আমাদের দেয়া হয়েছে কৃত্রিম শাস্ত্র। নতজানু সভ্যতা। জন্ম লাভের পর আমি আজ আর প্রকৃতির সন্তান নই। প্রকৃতির সকলকে ভালবাসার অধিকারও আমার নেই। আমার কপালে সেটে দেয়া হয়েছে জাতীয়তা, ধর্ম ও বর্ণের তকমা। আমি এর থেকে মুক্তি চাই।
বৃহস্পতিবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০১২
মুক্তমনাদের নৈতিকতার উৎস
যারা ধর্মে বিশ্বাস করে না, বলা হয়ে থাকে, তাদের কোন নৈতিকতাও থাকে না। তাদের মধ্যে থাকে না কোন মানবতা-বোধ। সমাজে তারা পশুর আচরণ করে বেড়ায়। তারা সমাজে বসবাসের অনুপযুক্ত। মানুষ হিসেবে যে সমস্ত মানবিকতা একজন মানুষের থাকা প্রয়োজন ধর্মে অবিশ্বাসীদের তা থাকে না। অর্থাৎ যেন ধর্মহীন মানুষ, মানুষ নয়, পশু।
অভিযোগগুলি পুরাপুরি মিথ্যা নয়! কারণ মানুষেরা প্রকৃত পক্ষে মানব পশু। মানুষের সচেতন অসচেতন মনে মননে আচার আচরণে মানব পশুর বিধি ব্যাকরণ কাজ করছে। সে অন্যান্য পশুদের মতই সকাল সন্ধ্যা খাদ্য ও আশ্রয়ের জন্য খেটে চলছে। পশুদের মতই সে যৌন সঙ্গম করছে। পশুদের মতই সে ভয় পেলে পালিয়ে যাচ্ছে। অন্যকে দুর্বল পেলে তার উপর হম্বি তম্বি করছে। আবার পশুদের মতই দলবদ্ধ বা সামাজিক ভাবে বসবাস করছে। সতীর্থদের প্রতি তার রয়েছে প্রেম, অনুরাগ ইত্যাদি। মানুষ মানব পশু বলেই তাদের মধ্যে এই সমস্ত সার্বজনীন আচরণ ও নৈতিকতা কাজ করছে। মানব প্রজাতির এই সমস্ত সার্বজনীন আচরণ ও নৈতিকতার অধিকাংশই অন্যান্য পশুদের আচরণের সাথে মিল থাকলেও মানব প্রজাতি হিসেবে তার নিজস্ব কিছু পৃথক সংযোগও রয়েছে। অর্থাৎ মানব পশু হিসেবে তার নিজস্ব কিছু নৈতিকতা তো অবশ্যই রয়েছে। এই নৈতিকতা কাজ করে তার সহজাত প্রবৃত্তি থেকে। এর সাথে যোগ হয়েছে সে যে সমাজে বাস করে সেই সমাজ বা গোষ্ঠীর দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠিত প্রথা থেকে। কিছু আসে রাষ্ট্র থেকে। কিছু আসে আধুনিক মানুষ হিসেবে যৌক্তিক গ্রহণ বর্জনের মাধ্যমে।
এই সামাজিক মানুষদের মধ্যে থেকে যারা ধর্ম করে তাদের নৈতিকতায় যুক্ত হয়েছে ধর্মীয় বিধি নিষেধ, ধর্মীয় নৈতিকতা। ধর্ম ভেদে এই নৈতিক মূল্যবোধগুলো ভিন্ন হতে পারে। এক ধর্মের দৃষ্টিতে যেটা নৈতিক অন্য ধর্মের দৃষ্টিতে সেটাই হয়তো অনৈতিক। সুতরাং এক ধর্মের লোকদের দৃষ্টিতে অন্য ধর্মের লোকদের অনেক কার্যক্রম অনৈতিক মনে হতেই পারে। কিন্তু সবারই রয়েছে নৈতিকতা। নৈতিক মূল্যবোধ বাদ দিয়ে কেও সমাজে বাস করতে পারে না। যারা কোন নির্দিষ্ট ধর্মে বিশ্বাসী নয়, তাদের মধ্যে রয়ে যায় সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, বিশ্ব মানবিক, প্রাকৃতিক নৈতিক মূল্যবোধ। সুতরাং যারা ধর্মহীন তাদের ধর্মীয় নৈতিকতার অবশ্যই অভাব রয়েছে কিন্তু তাদের রয়েছে মানব প্রজাতির বিশ্ব নৈতিকতা বা প্রাকৃতিক সার্বজনীন নৈতিক মূল্যবোধ। আর যারা ধর্মে বিশ্বাসী তাদের নৈতিকতা অনেক ক্ষেত্রেই সংকীর্ণতা দোষে দুষ্ট। তবে ধর্মীয় নৈতিক মূল্যবোধগুলোও আকাশ থেকে আসেনি। সেগুলো মানুষেরই তৈরি। তাই মানব প্রজাতির বিশ্বজনীন নৈতিকতার প্রতিফলন এতে রয়েছে। কিন্তু অন্যান্য ধর্ম থেকে নিজস্ব স্বকীয়তা রক্ষা করতে গিয়ে কিছু কিছু ধর্ম এমন কিছু নৈতিকতা গ্রহণ করেছে যা বিশ্ব মানবতার সাথে সাংঘর্ষিক। আবার রাষ্ট্রীয় আইনে সংরক্ষিত নৈতিকতাও বিশ্বজনীন নয়। অন্যান্য রাষ্ট্রের মানুষের প্রতি তাদের আচরণ প্রায়শই বৈষম্যমূলক। এমনকি নিজ রাষ্ট্রের বিভিন্ন শ্রেণীর নাগরিকদের প্রতিও নৈতিক আচরণ বিভিন্ন হয়ে থাকে। এভাবে মানব সমাজ যত গোষ্ঠী, জাতি, সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়েছে ততই তাদের নৈতিক মূল্যবোধ বিশ্বজনীনতা হারিয়েছে।
প্রকৃতিবাদ প্রকৃতি থেকে, বস্তুজগৎ থেকে জ্ঞান আহরনের কথা বলে। যা কিছু বস্তু জগতের কোন কিছুকে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত করে সেগুলোই বাস্তব জগতের অন্তর্ভুক্ত। প্রকৃতি জগতের এই প্রভাবিত-করণ বিশৃঙ্খল কিছু নয়। সব কিছুই নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম নীতি মেনে পরস্পর পরস্পরকে প্রভাবিত করছে। এই নিয়ম নীতি গুলোকে অনুমিত, পর্যবেক্ষণ, নিরীক্ষণের এবং পুনঃ পুনঃ যাচাই করণের মাধ্যমে আবিষ্কার করাই হল জ্ঞান আহরণের পদ্ধতি। বস্তু জগত বিশ্ব ব্রন্মান্ড সৃষ্টির আদি পর্ব থেকে অর্থাৎ অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বের আবির্ভাবের পর থেকে শক্তি, তরঙ্গ, কণা, তাপ ও গতির পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ায় পর্যায়ক্রমিক ভারসাম্যের ফল। পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া, ফল স্বরূপ পর্যায়ক্রমিক ভারসাম্য বিশ্ব ব্রন্মান্ডকে বিশৃঙ্খলা থেকে শৃঙ্খলা প্রদান করেছে। পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া, ফল স্বরূপ পর্যায়ক্রমিক ভারসাম্যই প্রাকৃতিক নীতি। পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া একটি ভারসাম্য অবস্থার অভ্যন্তরে সর্বদা চলমান প্রক্রিয়া। এর ফলেই একটি ভারসাম্য অবস্থা থেকে আর একটি ভারসাম্য অবস্থায় উত্তরণ ঘটে। এটাই প্রগতি। একজন প্রকৃতিবাদীর কাছে এই পর্যায়ক্রমিক ভারসাম্যের প্রাকৃতিক নীতিই মানুষের নৈতিকতার উৎস।
পাহাড়, নদী, জল, জীব বৈচিত্র্যের লীলা ভূমি এই পৃথিবীর বর্তমান এই রূপ ইকো-ভারসাম্যের ফসল। সমস্ত জীব জগতের মধ্যে পারস্পরিক ও ক্রমাগত ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার ফলেই তাদের বর্তমান এই ভারসাম্য। বেঁচে থাকার জন্য যেমন রয়েছে পারস্পারিক প্রতিযোগিতা, তেমনি রয়েছে পারস্পারিক সহযোগিতা। একজনের বেঁচে থাকা নির্ভর করছে আর একজনের বেঁচে থাকার উপর। এখানে কেউ কারো হুমকি স্বরূপ নয়।
লক্ষ লক্ষ বছরের বিবর্তনিয় ইতিহাসে প্রাণী জগতের বিভিন্ন প্রজাতি সমাজবদ্ধ ভাবে বসবাস করে আসছে। ন্যূনপক্ষে তারা তৈরি করছে যৌন বন্ধন। তাদের পারস্পারিক সামাজিক সহযোগিতাই প্রতিযোগিতা মূলক প্রতিকুল পৃথিবীতে টিকে থাকতে সাহায্য করেছে। আন্ত প্রজাতি নির্ভরতা এবং পারস্পরিক সহনশীলতাও টিকে থাকার ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করছে। তাদের এই আচরণ সহজাত। নৈতিক বিধিমালা হিসেবে এটি কোথাও লিখিত নেই। কোনরূপ ভয় থেকে বা পুরস্কারের লোভে তারা এই আচরণ করছে না। এই আচরণ হচ্ছে প্রজাতির স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিক আচরণ।
যা তার জন্য ভাল সেদিকে আকর্ষিত হওয়া এবং যা কিছু তার জন্য খারাপ সেদিকে বিকর্ষিত হওয়া প্রজাতির ধর্ম। আদি এককোষী জীব থেকে আরম্ভ করে বহুকোষী জটিল জীব পর্যন্ত প্রজাতির অনেকেই আলোর প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং অন্ধকার থেকে দূরে সরে যায়। আবার অনেকের ক্ষেত্রে এর উল্টোটাও ঘটে। প্রতিটি প্রাণী শিকারের প্রতি আকৃষ্ট হয় কিন্তু শিকারি থেকে পালিয়ে যায়। আবার অনেক সময় নিজেদের মধ্যে সহযোগিতার মাধ্যমে একজোট হয়ে উল্টো শিকারিকে ভয় পাইয়ে দেয়। নিজ প্রজাতির মধ্যে তারা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হয়। অধিকাংশ প্রজাতি দলগত ভাবে থাকতে ভালবাসে অর্থাৎ দলের প্রতি তাদের স্বভাবগত আকর্ষণ রয়েছে। অনেক তৃণভুজি প্রজাতি আবার অন্যান্য প্রজাতির সাথে একই চারণ ভূমি শেয়ার করে থাকে। পরস্পরের প্রতি এই যে সহনশীলতা এগুলো প্রজাতির আচরণগত বৈশিষ্ট্য।
প্রকৃতি জগতে সকল প্রজাতি পরস্পরের প্রতি বিধ্বংসী নয় বরং সহনশীল। বেঁচে থাকার জন্য যতগুলো শিকারের প্রয়োজন এর বাইরে অতিরিক্ত খুন করা হিংস্র প্রজাতির আচরণেও অনুপস্থিত। শিকারি প্রাণীগুলো নিজের টেরিটরি রক্ষার জন্য প্রথমে ভয় দেখাবে, তারপর আক্রমণ করবে। এই আক্রমণও বেশীরভাগ ক্ষেত্রে শক্তি প্রদর্শনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। অন্যদিকে একজনের টেরিটরিতে অন্য আরেকজন পারতপক্ষে অনুপ্রবেশ করে না। এই নিয়ম কানুনগুলো প্রাণী জগতের মধ্যে সহজাত।
প্রাণী জগতে যৌন প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে যতটুকু আক্রমণাত্মক মনোভাব দেখা যায় সেটাও শক্তি প্রদর্শনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে এবং আলফা পুরুষ বা আলফা স্ত্রীর সাথে চ্যালেঞ্জ-কারীর মধ্যেই চলে এই প্রতিযোগিতা। একবার এই প্রতিযোগিতার ফলাফল নির্ধারিত হয়ে গেলে পুনরায় সহনশীলতা ফিরে আসে। প্রাণী জগতে প্রতিশোধ পরায়ণতা, হিংসা, বিদ্বেষ, জিঘাংসা ইত্যাদি বেঁচে থাকা বা বংশ বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় নয় এইরূপ কোন বিধ্বংসী মনোভাবের অস্তিত্ব নেই।
জড় বা জীব প্রকৃতির সর্বত্রই ভারসাম্য বিদ্যমান বা ভারসাম্যের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। পরস্পরকে জায়গা করে দেয়ার রীতি বা পরস্পরের প্রতি সহনশীলতার নীতি বা পরস্পরের প্রতি নির্ভরতার নীতি প্রকৃতির সর্বত্রই বিরাজমান। জড় বা জীব প্রকৃতির এই রীতি নীতির জন্যই প্রকৃতির এই স্থিতিশীল অস্তিত্ব। রাতের অন্ধকারে আমরা যখন খোলা আকাশের দিকে তাকাই আমরা দেখতে পাই শান্ত প্রশান্তিময় এক তারকারাজির জগত। সংঘর্ষহীন ভাবে পরস্পর পরস্পরের প্রতি নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে সর্বদা ঘূর্ণয়নমান। পৃথিবীর বুকে আমরা দেখতে পাই পাহাড়, নদী, জল, বৃক্ষরাজির অপূর্ব সহবস্থানের দৃশ্য। প্রাণী জগতে বিভিন্ন প্রজাতির শান্তিময় সামাজিক কর্মকাণ্ড, আন্ত প্রজাতির পারস্পরিক সহনশীলতাময় সহাবস্থান, আদিবাসী বিভিন্ন মানব গোষ্ঠীর সহজ সরল গানে বাজনায় উল্লাসময় জীবন যাপন ইত্যাদি প্রকৃতির ইকো-ভারসাম্যের ফসল। এই ইকো-ভারসাম্যর মধ্যেই নিহিত রয়েছে প্রকৃতিবাদীদের নৈতিকতার উৎস। এর বাইরে কোন অলৌকিক উৎস থেকে অথবা গোষ্ঠী, জাতি, সম্প্রদায় বা শ্রেণীর স্বার্থ থেকে উৎসারিত নৈতিকতা অবশ্যই পক্ষপাত দোষে দুষ্ট হবে।
রবিবার, ১ জানুয়ারি, ২০১২
নতুন বছরের প্রত্যাশা
জীবন থেকে আর একটি বছর হারিয়ে গেলো। আজ ২০১২ সালের প্রথম সকাল। ভোর বেলা উঠে পূব আকাশের দিকে তাকালাম। এখনো সূর্য উঠেনি। কিন্তু দিগন্তে তার আভা ছড়িয়ে আছে। কালচে নীল মেঘের ছোপ ছাপিয়ে আলোর দ্যুতি ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। সেই আলোতে জরিয়ে রয়েছে শীতের কুয়াশা। জীবনে মাত্র বাহান্ন বার পেয়েছি বছরের এমন প্রথম ভোর! গভীর রাতের ভোরে ঘুম ভেঙ্গে গিয়ে আর ঘুম আসছিলো না। বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে অর্ধ-চেতন মন কেবলই ভাবছিল এই বাহান্ন বছর জীবনে পৃথিবীতে আমার অস্তিত্ব কোথায়?
কোথাও নেই! কারণ আজ যদি আমার দেহের মৃত্যু ঘটে পৃথিবীতে আমার আর কোন অস্তিত্ব থাকবে না। অর্ধ-চেতন মনেই ভাবছিলাম, জীববিদ্যা অনুযায়ী আত্মা বলে তো কিছু নেই যা আমাকে পরকালের অনন্তকালের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আমার দেহের সমাপ্তির সাথে আমার মনেরও এখানেই সমাপ্তি।
ভাবছিলাম আমার মন তো আমার মস্তিষ্কে সর্বদা অনুরণন রত স্মৃতিগুচ্ছ ছাড়া আর কিছুই নয়। অর্থাৎ আমি হলাম আমার মস্তিষ্কে অনুরণন রত স্মৃতিগুচ্ছ। আমার মস্তিষ্কের মৃত্যু ঘটলে আমার স্মৃতিগুচ্ছও হারিয়ে যাবে যদি না এটা কোথাও কপি করে রাখি! আমার স্মৃতিগুচ্ছের তিনটি ড্রাইভ রয়েছে। একটি হল সি ড্রাইভ। যেটার স্মৃতিগুচ্ছ আমার দেহকে পরিচালনা করছে। আমার দেহের বিভিন্ন জৈব রাসায়নিক সিগনালকে গ্রহণ করছে, প্রসেস করছে এবং তারপর বিভিন্ন জৈব রাসায়নিক সিগনাল আধারে নির্দেশনা পাঠাচ্ছে। এই ড্রাইভের স্মৃতিগুচ্ছের অনুরণনের ফলে আমি সুখ, দুঃখ, ক্ষুধা, ক্ষোভ, হিংসা, বিদ্বেষ, রাগ, অনুরাগ, তাড়না, বাসনা ইত্যাদি অনুভূতিগুলো অনুভব করে থাকি, যা আমার একান্ত নিজস্ব সম্পদ। দ্বিতীয় ড্রাইভটি মনে করি ডি ড্রাইভ। এর স্মৃতিগুচ্ছে রয়েছে আমার বাইরের জগত থেকে লব্ধ জ্ঞান এবং অন্যের স্মৃতিগুচ্ছের কপি। এর দ্বারা আমি নিজেকে সব সময় আপ টু ডেট রাখি। তৃতীয় ড্রাইভের স্মৃতিগুচ্ছে থাকার কথা আমার নিজস্ব উদ্ভাবন, রচনা, বানী, আবিষ্কার, সৃষ্টি যা অন্যের কাছে প্রয়োজনীয় মনে হয় এবং যেগুলো তারা তাদের ডি ড্রাইভে কপি করে রাখে। বিশ্বের মনিষী-গন তাঁদের এই স্মৃতিগুচ্ছ স্থাপত্য, ভাস্কর্য, ক্যানভাস, পুস্তক, টেকনোলজি, হস্তশিল্প ইত্যাদিতে হার্ড কপি করে অথবা গান, কবিতা, বাণী, বচন ইত্যাদি উপায়ে বহু লোকের স্মৃতিগুচ্ছে সফট কপি করে রাখেন। এভাবে মনিষী-গন পৃথিবীতে অমর হয়ে থাকেন। কালক্রমে তাঁদের নাম কালের গর্ভে হারিয়ে গেলেও তাঁদের স্মৃতিগুচ্ছ সামাজিক মস্তিষ্কে অথবা হিউম্যান মস্তিষ্কে অথবা চূড়ান্ত রূপে জেনেটিক কোডে বেঁচে থাকে।
বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক নাকি সংরক্ষণ করা আছে। আমি জানি না মানুষের মস্তিষ্ক বাইনারী পদ্ধতিতে কাজ করে কিনা। যদি করে থাকে এবং আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের ফ্রিজ হয়ে যাওয়া স্মৃতিগুচ্ছ যদি কোনভাবে কোন কম্পিউটারে কপি করা যায় এবং সেগুলোকে যদি যথাযথ ভাবে সক্রিয় করা যায় তবে কেমন হয়? সেই কম্পিউটারটি হয়তো আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক অথবা মন হিসেবেই কাজ করবে! আত্মা বা সেলফ যদি মস্তিষ্কের স্মৃতিগুচ্ছই হয়ে থাকে তবে সেটা হবে কম্পিউটার-ধারি আইনস্টাইন। অর্থাৎ বলা যাবে আইনস্টাইন তাঁর দেহ ছেরে কম্পিউটার ধারণ করেছেন! সেই কম্পিউটার রূপি আইনস্টাইনকে যদি বর্তমান যুগের উপাত্ত সরবরাহ করা হয় তাহলে হয়তো তিনি নতুন নতুন থিওরিও আবিষ্কার করতে পারবেন। বৈজ্ঞানিক থিওরি আবিষ্কারের জন্য হয়তো দেহ জাত অনুভূতির প্রয়োজন হয় না। তাই এখানে তাঁর দেহ না থাকলেও চলবে। এমনিতেই আমরা মনিষীদের ভাবনা বা স্মৃতিকেই গ্রহণ করে থাকি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনকে নয়। মনিষীরাও তাঁদের কাজ থেকে ব্যক্তিগত জীবনকে দূরে সরিয়ে রাখেন। বর্তমান যুগের বিখ্যাত মনিষী স্টিফেন হকিংসকে তো একজন মানুষ রূপি কম্পিউটারই বলা যায়। কারণ ব্যক্তিগত অনুভূতিগুলো বাদ দিলে বহির্বিশ্বের সাথে তার যোগাযোগ ঘটে যান্ত্রিক ইনপুট আউটপুট ডিভাইস দিয়ে।
অর্ধ-চেতন ঘুমের ঘোরে আমি দেখলাম আমার তৃতীয় ড্রাইভটি একদম শূন্য। অর্থাৎ দেহান্তরের পর পৃথিবীতে রয়ে যাওয়ার কোন উপায়ই আমার নেই। একটি দেহ জাত চাপা বেদনার অনুভূতি আমার ভিতর থেকে গলায় উঠে এলো। জানি এর মূল্য কারো কাছে নেই এবং আজ বাদে কাল এর মূল্য আমার কাছেও থাকবে না। মনের ভিতরে আকুলি বিকুলি করতে করতে মনে এলো আমার একটা ফেসবুক আইডি রয়েছে! সেটাই তো ভার্চুয়াল আমি! আমার সাথে বহির্জগতের যোগাযোগ হয় এই আইডির মাধ্যমে। এই আইডির মাধ্যমেই আমার নিজস্ব ভাবনা চিন্তা অনুভূতি, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ ঘটে। আমার ঠিকানা সর্বদা নেটে বিরাজ করে। এখানে যে কেউ আমাকে দেখতে পায়, যোগাযোগ করতে পারে। আমার স্মৃতিগুচ্ছের কিছুটা এখানে সংরক্ষিত আছে। আমার দেহান্তর ঘটলেও এই ভার্চুয়াল আমিতে আমি থেকে যাব। এখন এটাকে যদি আমার সংরক্ষিত চরিত্র ও জ্ঞান অনুযায়ী এমন একটা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সে পরিণত করা যায় যে সে নিজে নিজেই বহির্জগতের সাথে নিজের মতামত আদান প্রদান করতে পারে তাহলেই কিল্লা ফতে!
নতুন বছরের ভোরে ভবিষ্যতের এই আশার আলো দেখতে পেয়ে আমি একটা স্বস্তিতে পুনরায় ঘুমিয়ে পরলাম।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যসমূহ (Atom)

