বৃহস্পতিবার, ১৬ জুন, ২০১৬

বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রম

বর্তমানে বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রম উৎপাদন শক্তির পরিসরে এক ধরণের বিপ্লব এনেছে বলা যায়। এর ফলে মানুষ শুধুমাত্র নির্দেশনা দিয়ে যন্ত্রকে যে কোন কাজ করাতে পারে।
প্রথম যুগের যন্ত্র উৎপাদন চেইন দ্বারা অনেক শ্রমিকের শ্রমকে নিবিড়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে উৎপাদিকা শক্তি বাড়িয়ে তুলত। এর জন্য প্রয়োজন হত বিরাট বিরাট কারখানা এবং বহু সংখ্যক শৃঙ্খলাবদ্ধ শ্রমিক।
বর্তমানে বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রম যে কোন জায়গা থেকে ব্যক্তিগত উৎপাদন থেকে শুরু করে বৃহৎ পরিসরের উৎপাদন বা বৃহৎ কোন সিস্টেমের পরিচালনা করতে পারে।
অর্থাৎ বুদ্ধিবৃত্তিক নির্দেশনা মানুষের দৈহিক শ্রমকে আর উৎপাদনের জন্য অপরিহার্য্য করে তুলছে না। অনেক ক্ষেত্রেই যান্ত্রিক শক্তি পেশী শক্তিকে প্রতিস্থাপন করছে।
পুঁজিবাদী প্রতিযোগিতার ফলে বেশী বেশী যন্ত্র নির্ভর ও পুঁজি নির্ভর হয়ে পড়ছে। কিন্তু শ্রমিক কমে যাওয়ায় মুনাফা করাও অসম্ভব হয়ে পড়ছে।
পুঁজি তাই বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রমকেই পণ্যে পরিণত করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। বিভিন্ন আইনের মধ্যমে বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানকে চাইছে পুঁজির দাসে পরিণত করতে।
পূর্বে শ্রমিকদের শ্রমশক্তিকে পণ্যে পরিণত করে পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রায়শই অতি উৎপাদনের দুষ্টচক্রে পরে যেত। সেক্ষেত্র বর্তমানে বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রমের যুগে শ্রমের তুলনায় উৎপাদন বহু বহু গুণ বেশী।
বুদ্ধিবৃত্তিক দক্ষতা লাভের জন্য প্রয়োজন হয় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। তাই এই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও একটি লাভজনক পণ্যে পরিণত হয়েছে।
বুদ্ধিবৃত্তিক জনবল এক নতুন ধরণের শ্রেণীর বৈশিষ্ট লাভ করেছে। যারা বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রমের মালিক এবং এই পর্যায়ে উন্নত হতে তাদের কিছুটা বিনিয়োগও করতে হয়েছে।
বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান যেমন পণ্য হিসেবে বিক্রি করা যায়, আবার বিনা মূল্যে বিতরণও করা যায়! এবং যা বিতরণ করা হয় তার ব্যবহারিক মূল্য কোন অংশেই কম নয়।
অনেক শুন্য মূল্যের বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান বর্তমানে কোটি কোটি মানুষের ব্যবহারিক ও উৎপাদনের কাজে লাগছে। এগুলির মালিকানা যেমন ব্যক্তিগত তেমনি সামাজিক। অর্থাৎ এই উৎপাদনের কোন পণ্য মূল্য নেই। আবার এর মালিকানা যে ব্যবহার করে তার! (চলবে)।

বুধবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৪

পাকিস্তানে ছাত্র হত্যা না জিহাদ?

বোকো হারাম শত শত স্কুল ছাত্রীদের গুম করে ফেললো। গতকাল পাকিস্তানে শতাধিক ছাত্রকে বোমা মেরে / গুলি করে হত্যা করা হোল। তালেবানরা বললো এটা জিহাদ অর্থাৎ ধর্মযুদ্ধ ! ধর্মযুদ্ধ হোল ধর্ম প্রসারের জন্য বিধর্মীদের বিরুদ্ধে, বিধর্মী দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। বিভিন্ন নামের সকল ধর্মীয় গোষ্ঠীই বলছে তাদের এই জিহাদি যুক্তির উৎস একই পবিত্র ধর্ম গ্রন্থ। বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমান এই গ্রন্থই অনুসরণ করে বলছে ইসলাম শান্তির ধর্ম। বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য আমাদের জিহাদ করার প্রয়োজন হয়নি। আমরা করেছিলাম স্বাধীনতা যুদ্ধ। কিন্তু আফগানিস্তানে তালেবানরা বলছে এটা তাদের জিহাদ।

আমরা যারা সাধারণ জনগণের উপর জিহাদের নামে আক্রমণের বিরুদ্ধে, আমরা যারা নারী/শিশুদের শিক্ষা লাভের সুযোগের পক্ষে, তাদের বিক্রি করে দেয়ার বিরুদ্ধে এবং আরো অনেক পশ্চাতপদতা সমর্থন করি না তারা কি শুধু নিন্দা জানিয়েই এই বিষবাষ্প থেকে মুক্ত থাকতে পারবো? নিদেন পক্ষে বিভ্রান্তিকর ধর্মীয় যুক্তির বিরুদ্ধে সমালোচনার অধিকারও আমরা পাবো না?

এই বিষবাষ্প আজ সমাজে সন্তপর্নে নিঃসরিত হয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অনেককে গ্রাস করে চলছে এটা আমরা দেখেও না দেখার ভান করছি। আমাদের উঠতি বয়সের তরুণেরা রাস্তা ঘাটে, খেলার মাঠে, ভর্তি কোচিং এ এই জিহাদিদের সহজ শিকারে পরিণত হচ্ছে। প্রতিবাদ করার সাহস কারো হচ্ছে না। এমন কি নারী জিহাদিরা গৃহে গৃহেও ঢুকে পড়ছে। তৈরি করছে বিভিন্ন ধরণের গ্রুপ। মূল সমস্যা হচ্ছে ধর্ম সম্পর্কে সাধারণ মানুষের বিভিন্ন বিভ্রান্তিকর ধারণা। এমনকি পরিবারে, বন্ধু মহলে এগুলো নিয়ে মুক্ত আলোচনার কোন সুযোগ নেই। আলোচনা করতে গেলেই কেউ কেউ ভয়ংকর অনুভূতি প্রবণ হয়ে পরেন অথবা অনেকেই মুক্ত আলোচনাকে সযত্নে এড়িয়ে চলেন। ফলে তথাকথিত জিহাদিদের জন্য আমাদের সমাজ হোল এক উন্মুক্ত চারণ ক্ষেত্র।

গণতান্ত্রিকরা ধর্মীয় অজ্ঞতাকে প্রসয়/সমর্থন দিয়ে ভোটের বাক্স ভরতে চান।

প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা ধর্মের সমালোচনাকে সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দেয়া মনে করেন।

সমাজতন্ত্রীরা মনে করেন শ্রেনিযুদ্ধই সকল সামন্তীয় অবশেষের অবসান ঘটাবে।

বিলোপবাদী বামরা মনে করেন এটা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এক ধরণের মুক্তিযুদ্ধ।

তথাকথিত মুক্তমনারা ধর্মীয় মনিষীদের ব্যক্তিগত আক্রমণ করে সুস্থ যুক্তিতর্ককে অঙ্কুরেই জলাঞ্জলি দেন।

আর আমরা শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি এই সুযোগে আমাদের উঠতি বয়সের তরুণ ছেলে / মেয়েদের ঘিরে আছে একদল শিকারি।  

বৃহস্পতিবার, ৯ অক্টোবর, ২০১৪

আদর্শিক সততার নায়ক ভাষা সৈনিক আবদুল মতিন

ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিনের জীবনাবসান হল। সুদীর্ঘ্য ৯৪ বছর তিনি বেঁচেছিলেন। বেঁচে ছিলেন এই সমাজের যত কুলষতা, বৈষম্য, নির্যাতনকারিদের বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। তিনি ভালবাসতেন মানুষকে। তাই মানুষের বিরুদ্ধে মুনাফালোভী শাসকশ্রেণীর যে কোন চক্রান্তের তিনি ছিলেন অগ্রগামী প্রতিবাদকারী। স্বভাবতই দর্শনগত ভাবে তিনি ছিলেন নাস্তিক। কিন্তু তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়ীক। শুধু ধর্মীয় বৈষম্যই নয়, তিনি ছিলেন জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ সকল বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার। তিনি কখনই একপেশে তথাকথিত মুক্তমনাদের মত ধর্ম বিদ্বেষী ছিলেন না। বরং তিনি ছিলেন বিজ্ঞান মনষ্ক।  তিনি সামাজিক বিজ্ঞান, ঐতিহাসিক বস্তুবাদের চর্চা করেছেন, মানুষকে তিনি বিজ্ঞানের আলোয় শিক্ষিত করতে চেয়েছেন, যে চর্চায় অধিবিদ্যাবাদ আপনিতেই ঝরে পরে। তাই তিনি কখনই শোষিত জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হননি। তিনি ভাষা আন্দোলন করেছেন, মাতৃভাষার মর্যাদা চেয়েছেন, তাই বাংলাদেশের অন্যান্য শতাধিক ভাষার মর্যাদাকেও তিনি উর্দ্ধে তুলে ধরেছেন। তিনি শোষিত মানুষদের অর্থনৈতিক রাজনৈতিক মুক্তি চেয়েছেন কিন্তু শোষিত মানুষদের হিন্দু, মোসলমান, বাঙালি, বিহারি, চাকমা, মারমা, আর্য্য, দ্রাবিড়, নারী, পুরুষ ইত্যাদি ভাগে বিভক্ত করেননি। তাই তার মুক্তিযুদ্ধ ছিল সার্বিক মানুষের মুক্তিযুদ্ধ, শুধুমাত্র বাঙালি জাতির আংশিক মুক্তিযুদ্ধ নয়। তাই শোষক শ্রেণীর বর্তমান রাষ্ট্র তাঁকে ধারণ করতে পারে না। তাঁর আদর্শিক সততার কাছে মাথা নত করলেও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা তাঁকে দিতে পারে না। তাঁর মর্যাদা এর থেকে অনেক বড়। তিনি পেয়েছেন জনগণের মর্যাদা। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি নাস্তিক ছিলেন কিন্তু হিপোক্রেট ছিলেন না। তাই তিনি তাঁর মরদেহ বিজ্ঞানের উদ্দেশ্যে দান করে গেছেন। জনগণ তাঁর এই দান সশ্রদ্ধ চিত্তে গ্রহণ করেছে। তাঁর অবদান যেমন সাধারণ মানুষের কাছে চির অম্লান হয়ে থাকবে, তেমনি তাঁর কাছে প্রগতিশীলদের, মুক্তমনাদের শিক্ষণীয় রয়ে গেছে অনেক কিছু। 

বুধবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১৪

মানুষ এবং এনিমেল ইনস্টিংক্ট

মানুষ নিজেকে যতই উন্নত জীব হিসেবে মনে করুক না কেন আচার আচরণের দিক থেকে সে এনিমেল ইনস্টিংক্ট দ্বারাই পরিচালিত হয়। মানুষ হাস্যকর ভাবেই নামমাত্র জন্তু! একটা কুকুরের মতই সে খাবারের সন্ধানে থাকে, রাত হলে ঘুমায়, বিশ্রী মল ত্যাগও করতে হয়, যৌন মিলনের মত জঘন্য কাজটিও করে এবং সেই সময়ের শীৎকার/অভিব্যক্তি কুকুরের চেয়েও নিন্মমানের! 

মানুষের সামাজিক আচরণও পশুদের চেয়ে ভিন্ন নয়! খাদ্যের প্রাপ্যতার উপর নির্ভর করে তারাও কখনো একক পরিবার কখনো একান্নবর্তি পরিবার, গোষ্ঠী, ক্ল্যান গঠন করে। প্রতিটি পুরুষই নিজেকে আলফা পুরুষ ভাবে এবং সাধ্য অনুযায়ী একটা টেরিটরি তৈরী করে নেয়। তার অধীনস্ত সকল পুরুষকে সে শাসনে রাখে। আর আলফা হতে না পারলে আলফা পুরুষের তোষামদ করতে থাকে। আর দুজন আলফা হলে তাদের মধ্যে চলতে থাকে জিঘাংসার যুদ্ধ। সকল নারীদের তার কাছে মনে হয় অসহায় এবং সে তাদের রক্ষাকর্তা। মনে মনে সে সকলকেই তার হেরেমভুক্ত মনে করে। অন্য পুরুষ তাদের প্রতি আগ্রহ দেখালে সে মনে মনে চটে যায়। নারীদের পৃথক কোন সত্ত্বা সে পছন্দ করে না। সে অন্য পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হলে তাকে শাস্তি দিতে চায়। পরিবার থেকে, পাড়া, কর্মস্থল, সংগঠন সব ক্ষেত্রে পুরুষের আচরণের পিছনে এই এনিমেল ইনস্টিংক্ট কাজ করে। 

নারীদের মধ্যেও আলফা নারী হওয়ার প্রবনতা কাজ করে। তার টেরিটরির মধ্যে সে সকল নারীদের অধীনস্ত রাখতে চায়। সকল পুরুষকে রাখতে চায় অনুরাগী। এর ব্যত্যয় ঘটলে সে তোষামোদির আচরণ করে, ভিতরে থাকে জিঘাংসা। পুরুষেরা তাকে অসহায় মনে করলেও তারা পুরুষদের মোটেও ভয় পায় না এবং নিজেকে অসহায় মনে করে না! শারীরিকভাবে পুরুষেরা শক্তিশালী এটা তারা জানে এবং পছন্দ করে। সে জানে তার প্রতি পুরুষের আচরণ পুরুষের প্রতি পুরুষের আচরণ থেকে সম্পুর্ন ভিন্ন। এবং যে কোন শক্তিশালী পুরুষকে পোষ মানানোর ক্ষমতা তার আছে। পুরুষেরা যেমন সকল নারীকে তার হেরেমভুক্ত মনে করে, নারীরা সেভাবে পুরুষদের দেখেনা। তার কাছে সুরক্ষিত স্থানে সন্তান পালনের ব্যপারটি গুরুত্বপূর্ণ। তাই প্রেমিক হিসেবে সকলকে দেখলেও আলফা পুরুষ হিসেবে সংসার রক্ষা করতে পারবে এমন পুরুষ সে পছন্দ করে। এ সব কিছুই এনিমেল ইনস্টিংক্ট দ্বারা পরিচালিত হয়। 

এই সমস্ত আচরণ লক্ষ লক্ষ বছর ধরে মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছে। প্রতিবেশ পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে সে বিবর্তিত হয়ে উন্নত হয়েছে। কিন্তু গোল বেঁধেছে সে যখন সাধারণ জন্তু থেকে নিজেকে মানুষ হিসেবে পৃথকভাবে চিহ্নিত করেছে, এবং সামাজিক ভাবে পুরুষ ও নারীর ভিন্ন সংজ্ঞা তৈরি করেছে। সে আর এক উপাখ্যান!

শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

কলকাতা দর্শন - দুই


ভ্রমণে বেড়িয়েছি অগাস্ট মাসের তিন তারিখে। ঘুরাঘুরির জন্য এটা যথাযথ সময় নয়। দেশে থাকতেই সুহ্রিদরা সাবধান করেছিল এই ঋতুতে প্রচন্ড গরমের জন্য কলকাতা ঘুরতে পাড়ব না। কিন্তু উপায় ছিল না। রোজা ঈদ পূজা মিলিয়ে এসময় বেশ বড় একটি ছুটি ছিল। এই সময়ের বাইরে আগামী দুই বছরের জন্য আর কোন ফাঁক নেই। তাই এটাই আমাদের জন্য মোক্ষম সময়। তাছাড়া রোজা ঈদ পূজা আমাদের মত নাস্তিক পরিবারের জন্য কোন সমস্যার কারণ ছিল না। বরং ভাবলাম এসময় পর্যটকদের ভিড় একটু কমই থাকতে পারে। কিন্তু আমার এ ধারণা সঠিক ছিল না। ঈদ পার্বণেই নাকি বাংলাদেশের এক শ্রেণীর লোকেরা কেনাকাটার জন্য কলকাতা, সিংগাপুর, দুবাই যাতায়াত করে থাকে। তাই ভিসা পাওয়ার পরদিনই বেড়িয়ে পরার ইচ্ছা থাকলেও বাসের টিকিট পেলাম তিন দিন পরের। রাত এগারটায় কল্যাণপুর থেকে বাস ছেড়ে সকাল আটটায় বেনাপোল নামিয়ে দিল। এসি বাস। সারারাত আরামে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলাম। সকালের দিকে বাংলাদেশের ভাগে জানালা দিয়ে যেরকম অভ্যস্ত গ্রামীণ দৃশ্যগুলো দেখেছি, সীমান্ত পার হবার পর সেই দৃশ্যপট কিছুটা পালটে গেল। বাংলাদেশের ভাগে যশোর রোড মোটামুটি প্রসস্ত, দুই লেন, নোতুন। রাস্তার দুপাশ গাছ বিহীন পরিস্কার। রাস্তার উপর সেরকম দোকান পাটও নেই। সীমান্ত দ্বারে বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন কার্য্যালয়টি যাত্রীদের সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন একটি আধুনিক স্থাপত্যের সুন্দর দ্বিতল ভবন। পাশে এরচেয়ে বড় আর একটি ভবণ নির্মান হচ্ছে। ভারতের দিকের কার্য্যালয় বলতে রঙচটা হীন কয়েকটি বিচ্ছিন্ন একতালা কক্ষসমষ্টি। অধিকাংশ সময় যাত্রীদের ঝড় বাদলে বাইরে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।

পাবলিক বিল্ডিং বলে একধরণের ভবন রয়েছে যেখানে জনগনকে বিভিন্ন সার্ভিস দেয়া হয়। জনগনের পয়সায় সেগুলো তৈরি করা হয়। জনগনই সেই ভবনের কর্মচারীদের বেতনের টাকা যোগায়। সার্ভিসের চাহিদা অনুযায়ী সে সমস্ত ভবনে থাকবে যথেষ্ট পরিসরের লাউঞ্জ এবং শৌচাগারের মত সুবিধাদি। যেখানে সকলেই যেন অপেক্ষা করতে পারে। কিন্তু আমাদের এবং আমাদের মত প্রাক উপনিবাসিক দেশে পাবলিক ভবন হোল জমিদারী আমলের কাচারি ঘরের মত। যার সামনে প্রজারা খাজনা পরিশোধ করবে বলে করজোড়ে অপেক্ষা করে থাকে। নায়েবদের রক্ত চক্ষুর সামনে যারা নিতান্তই অসহায়। এমনকি উন্নত দেশগুলি তাদের নিজেদের নাগরিকদের সন্মান দিলেও আমাদের দেশে দূতাবাসগুলোতে আমাদের সাথে একই নায়েবী আচরণ করে থাকে!  


আচার আচরণে স্বভাব চরিত্রে নায়েব প্রজার ঐতিহ্য ধরে রাখলেও নায়েবি আমলের ঐতিহাসিক নিদর্শণগুলো মুছে ফেলতে আমরা খুবই আগ্রহী। যশোর রোডটি সেই নবাবী আমলের রোড। ভারত বাংলাদেশের দুদিকেই এই ঐতিহ্যবাহী মহাসড়কের দুধারে শতবর্ষ বয়সী শিরিষ, মেহগনি, শাল গাছ গুলো দীর্ঘদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল।
Indo-Bangladesh border, Benapole, Bangladesh
 ছবিঃ  কৌসিক

 এমন কি এই গাছের সাড়িগুলো আমরা কয়েক দশক পূর্বেও সাভার হয়ে ঢাকা পর্যন্ত বিস্তৃত দেখেছিলাম। বাংলাদেশের দিকে অপরিকল্পিত ভাবে রাস্তা উন্নয়ন করে এই গাছগুলোকে কেটে ফেলা হয়েছে। ভারতের দিকে এই গাছগুলো রক্ষার একটা প্রচেষ্টা চলছে। তারা রাস্তা গাছ কেটে দুদিকে না বাড়িয়ে একপাশের গাছের সারি মাঝখানে আইল্যান্ডে রেখে পাশে সুম্পূর্ন নূতন আর একটি রাস্তা করছে।

বেনাপোল থেকে কলকাতা বাসে দুই ঘন্টার পথ কিন্তু সময় নেয় চার ঘন্টা। কারণ অপ্রসস্ত রাস্তায় স্পীড উঠানো যায় না। তাছাড়া রাস্তার দুধারে প্রায়ই দোকান পাট, বাজার, মানুষের জীবন প্রবাহ রাস্তায় মানুষের ভীড় করে রেখেছে। যেখানে বাংলাদেশের অংশে রাস্তার দুধারে সবুজ ফসলের ক্ষেত দৃষ্টিকে প্রসারিত করে রেখেছিলো। এদিকে পূরানো পূরানো ঘর বাড়ি, দোকান পাট, বাজার, মফঃস্বল শহর রাস্তাটিকে সচল করে রেখেছে। দুদিকের দৃশ্যপটের পার্থক্য খুঁটিয়ে দেখলে বেশ চোখে পরার মত। বাংলাদেশ পার হলেই বিলবোর্ডের লেখাগুলো বেশ চোখে বাজে। ফন্টগুলো পূরানো ধাঁচের। রঙের ব্যবহার ও ডিজাইনে নতুনত্ব নেই। দোকানগুলো ছোট ছোট, অনেক দোকানদারই খালি গায়ে বসে আছে। এদিককার একতলা বাড়ী ঘরে এখনো বেশ টালির ব্যবহার রয়েছে। দশ বার ফিট অপ্রসস্ত বাড়ীগুলো পেছনের দিকে লম্বা হয়ে গেছে। সামনের অংশ প্রায়ই দোকান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ভবণগুলোর বারান্দায় কোন ড্রপ নেই। ফলে কাঠামো বেড়িয়ে থাকায় দেখতে ভাল দেখায় না। ফাঁকে ফাঁকে গ্রামের অংশে প্রায়ই পাটক্ষেত চোখে পরল। মনে হয় কৃষকেরা পাটের ভাল দাম পায়। কিন্তু আমাদের ওদিকে পাটের চাষ নাই বললেই চলে।

আমাদের বাসটি কলকাতায় প্রবেশ করলো দম দম এয়ারপোর্টের পিছন সীমানা দিয়ে। রাস্তার দুপাশে আগাছায় পূর্ন খোলা নর্দমা। প্রায় বেশ কিছুক্ষণ ধরে এই রাস্তা পার হতে হয়। একটি ঐতীহ্যবাহী শহরের অভ্যর্থনা পথটি মোটেই সুখকর নয়।  হতে পারে আমাদের বাসটি সেই পথ ধরে যায়নি। কারণ কলকাতা শহরটিতে জালিকার ন্যায় অসংখ্য ক্রস রোড বিছানো। ঢাকার মত এটা শুধু তিনটি রোড দ্বারা সংযুক্ত নয়। ফলে কোন গন্তব্যে যাওয়ার অনেক বিকল্প রয়েছে, আপনি আপনার সুবিধা মত যে কোন পথে যেতে পারেন। দম দম থেকে ধর্মতলা বাসে প্রায় দুই ঘন্টার পথ। নতুন পূরানো রাস্তায় মানুষ ও যানবাহন উপচে পরছে না। কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা। বিল্ডিংগুলো চার পাঁচ তলার বেশি নয়।
বেশির ভাগই সাধারণ মানের। তবে পুরানো শহরে এলে একটা এরিস্টোক্রেসি অনুভব করা যায়।  দুধারে প্রশস্ত ফুটপাথ ও রাস্তা ফুটো ফাটাহীন কালো নিরেট পাথরের তৈরী বলে মনে হয়। বিল্ডিং, চত্বর, রাস্তা, সবকিছুই বাঁধানো এবং নতুন নির্মানাধিন ভবন নাই বলে কন ধূলো কাদা নাই। রট আয়রনের নক্সা করা রেলিংযুক্ত ঝুলন্ত বারান্দা ও সবজে নীল রঙের ঘুলঘুলি অয়ালা দরজা জানালা নিয়ে চূন পলেস্তরা ক্ষয়ে যাওয়া  সারি সারি ভবনগুলো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিচিত্র ধরণের ব্যবসা ও থাকার বোর্ডিং ভবনগুলো প্রান চাঞ্চল্য করে রেখেছে। রাস্তায় সিএনজি, রিকসা নাই। তবে হলুদ ও সাদা রঙের প্রচুর এম্ব্যাসেডার গাড়ী রাস্তার দুপাশে সারিবদ্দ দাঁড়িয়ে আছে। ট্রাম লাইনে ট্রাম ও মুড়ির টিন বাসগুলো কিছুক্ষণ পর পর নিঃশব্দে আপ ডাউনে চলাচল করছে। ক্লান্ত পায়ে মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত মানুষ ফুটপাথ ধরে হেঁটে যাচ্ছে, বাসে উঠছে নামছে। টাইট জিন্সের প্যান্ট সার্ট পড়া শুকনো মেয়েরাও এই দলে আছে। এই সব দেখে দেখেই আমরা একসময় মারকুইস স্ট্রীটে পৌঁছে গিয়েছিলাম।

বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

কলকাতা দর্শন - এক


কলকাতা দর্শন - এক 

ভেবেছিলাম ছোটবেলা থেকে প্রচুর উপন্যাসের মাধ্যমে চির চেনা কলকাতাতে ভ্রমণ করব। সেই চৌরঙ্গী লেন, সেই ডালহৌসি স্কয়ার, সেই গড়ের মাঠ, সেই কলেজ স্ট্রিট, কফি হাউস, বর্ধমান হাউস, সেই কালীঘাট, পূজা মণ্ডপ, অলি গলির মোড়ে মোড়ে রকে বসে তরুণ যুবাদের আড্ডা, মাটির বাটিতে চা, লুচি কচুরি ইত্যাদি কলকাতার সাথে মিশে থাকা কলকাতার জীবন স্পন্দনকে অনুভব করব।  কিন্তু সে আর হয়ে উঠেনি। দুদিন পরই সেখান থেকে পালাতে হল। তাই কলকাতা আর ভ্রমণ করা হল না। এটাকে  আংশিক দর্শন বলাই ঠিক হবে। সেই সঙ্গে একটি ভ্রমণ কাহিনী লেখার সুপ্ত বাসনাটিও উবে গিয়েছিল। শুধু দর্শন করে তো আর ভ্রমণ কাহিনী লেখা যায় না। সেটা হতে পারে বড়জোর একটি দর্শন কাহিনী। পরে ভাবলাম এটাই লিখে ফেলি। কারণ এর চেয়ে বেশী যোগ্যতা যে আমার নেই, সেই সত্যতা মেনে নেয়াই বরং ভাল। তাহলে আর যাই হোক সম্মানিত পাঠকের প্রত্যাশাটা তো আর ভঙ্গ হবে না!  
ক্ষুদিরামের ভাস্কর্য্য 

সকাল এগারোটায় শ্যামলী পরিবহণের বাসটি আমাদের মারক্যুইস স্ট্রীটে নামিয়ে দিল। পুরানো কলকাতার ধর্মতলায় এটি একটি অতি সাধারণ সড়ক। প্রধান সড়ক থেকে বেশ ভেতরে একটি পাতি সড়ক। ঢাকায় যেমন আন্তঃজেলা বাসগুলো শহরের প্রবেশ মুখে নির্দিষ্ট যাত্রী ছাওনিতে নামিয়ে দেয় এখানে তেমনটি ঘটলো না। যশোর রোড থেকে কলকাতা শহরের প্রবেশের মুখে এমন কোন যাত্রী ছাওনি আমাদের চোখে পড়ল না। শহরে প্রবেশের পর এই প্রান্ত থেকে প্রায় অপর প্রান্তে নিয়ে গিয়ে বাসটি আমাদের বাড়ীর দোরগোড়ায় নামিয়ে দিল। বাস থেকে নেমেই দেখি সামনে বন্ধুর পরামর্শ দেয়া হোটেলটি দাঁড়িয়ে আছে!

মনে মনে বেশ খুশী হলাম। কারণ আমাকে আর গাট্টি বোঁচকা সামলাতে সামলাতে হোটেল খুঁজতে হবে না। এখানে বলে রাখি গাট্টি বোঁচকা যেন আমাকে একা বহন করতে না হয় সে জন্যে ভ্রমণ পরিকল্পনার সময় একটি চালাকি করেছিলাম কিন্তু তাতে পুরোপুরি  সফল হতে পারিনি। আমি চেয়েছিলাম চারজনের পিঠেই একটি করে ট্র্যাভেল ব্যাগ থাকবে এবং তাতে যার যার মাল সে ই বহন করবে। কিন্তু আমার স্ত্রী তিনটির বেশি কিনতে দিল না। বাসা থেকে বেরোবার সময় আমার দুই ছেলে মেয়ে তাদের পিঠে তাদের ব্যাগ উঠিয়ে নিলো। আমার পিঠে আমারটি নিয়ে যেই রওনা হয়েছি, আমার স্ত্রী একটা হ্যান্ড ট্রলি আমার হাতে ধরিয়ে দিল! তার পিঠ ফাঁকা, যদিও কাঁধে রয়েছে ঢাউস সাইজ একটি ভ্যানিটি ব্যাগ। আসল জিনিসটি ঠিকই তার হস্তগত রয়েছে। শুভ যাত্রা পথে তখন আর কোন উচ্চবাচ্য করতে পারিনি। আর যাই হোক, আজীবন এই ভার বহন করতেই হবে যখন। ভুল গোঁড়াতেই হয়েছিল। দুজনের চুক্তিতে সংসারের ভার সমান ভাবে বহন করার বিষয়টি উল্লেখ থাকলেও বোঁচকা বহনের শর্তটি অন্তর্ভুক্ত করতে পারিনি। সেই জন্যই আজ এই খেসারত।

কিন্তু কপালের লিখা কে করিবে খণ্ডন? বোঁচকা বহনই আমার ভবিতব্য। হোটেলের বাহ্যিক চেহারা দেখেই আমার কলেজ পড়ুয়া মেয়ে এক কথায় সেটা নাকচ করে দিল। এটাতে সে থাকবে না! কম কথা বলা আমার মেয়েটি ব্যাখ্যা বিবৃতির ধার ধারে না। না বলেছে তো না। এরপর  মান কি না মান  এটা তোমার ইচ্ছা। তোমার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে সে আর কোন উচ্চ বাচ্য করবে না, মান অভিমানও করবে না। তার ছোট ভাইটি সব সময় বোনের সিদ্ধান্তের পক্ষে একটি হাসি দিয়ে তার সায় জানাবে। তাদের মা প্রতিবাদী কন্ঠে উপদেশ বাক্য আরম্ভ করলেও ততক্ষণে আমি অন্য হোটেল অন্বেষণে হাটা ধরেছি। সত্যি বলতে কি মেয়ের অমন শীতল মতামত আমার পক্ষে খণ্ডন করা সম্ভব হয় না। তাছাড়া যতটুকু বোঝা গেল ব্যবসায়িক বন্ধুর পছন্দনীয় হোটেলটি সাশ্রয়ী ও ব্যবসায়ীদের জন্য উপযোগী হলেও পরিবার উপযোগী নয়। নান্দনিক চেহারাটিও ছাল চামরা হীন পুরানো ধাঁচের, যা আজকালকার মেয়েদের পছন্দ হওয়ার কোন কারণই নেই।

পরবর্তী লক্ষ্য হোল ডাক্তার শ্যালকের পরামর্শ দেয়া হোটেল। রাস্তায় কোন রিকসা বা সিএনজি চোখে পড়লো না। লট বহর নিয়ে সামনের ফুটপাথ ধরে এমন ভাব নিয়ে অগ্রসর হলাম যে এই শহরের সকল রাস্তা ঘাট আমার নখ দর্পণে। এই ভাবের কারণ রয়েছে, যেন কোন দালাল বুঝতে না পারে আমরা নতুন মাল সদ্য বাংলাদেশ থেকে এখানে অবতরণ করেছি। দেশে থাকতে ডাক্তার শ্যালক পই পই করে বলে দিয়েছে কোন দালালের খপ্পরে যেন না পরি। আমার এই শ্যালক পর্যটক হিসেবে একজন ভারত বিশারদ। শুধুমাত্র পর্যটনের নেশায় অসংখ্যবার ভারতের বিভিন্ন আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছে। তাই ডাক্তারি পরামর্শ থেকে অনেক বেশী আগ্রহ রয়েছে পর্যটনের পরামর্শ দিতে। আমরা প্রথমবার ভারত যাব শুনে আমাদের থেকে তারই উৎসাহ যেন অনেক বেশী। আসার সপ্তাহ খানেক আগেই টাইম টেবল সহ তিন পাতার পুরো একটা ভ্রমণ শিডিউল ইমেইল করে পাঠিয়ে দিল। আমি অবশ্য প্রথমে সেই ইমেইলটি খুলিলি। ইন্টারনেট  ঘেঁটে ঘেঁটে আমি নিজেই সকল গন্তব্যের রুট ম্যাপ, পছন্দনীয় হোটেলের ঠিকানা ইত্যাদি স্মার্ট ফোনে নির্দেশনা দিয়ে রেখেছি। প্রয়োজন হলেই চেক করে নিতে যা অপেক্ষা।

তা বেনাপোল সীমান্তে ইমিগ্রেশন পার হয়ে শ্যালকের পরামর্শ অনুসরণ করেই অগ্রসর হচ্ছিলাম। তার পরামর্শ ছিল কোন দালালের খপ্পরে পড়া যাবে না। আমরা দালালের টানাটানি পাত্তা দিলাম না। বাংলাদেশের দিকে পরিবহণ বাসের কর্মচারীরা অতি যত্নের সাথে বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন পার হতে সহায়তা করে আমাদের ভারতের পরিবহণ কর্মচারীদের হাতে সপে দেয়। তারা আবার এপারের ইমিগ্রেশণ পাড় করে তাদের যাত্রী ছাউনিতে নিয়া আসে।  শ্যালক সীমান্তেই সকল ডলার ভাঙ্গিয়ে নিতে বলেছিল, তাতে ভাল দাম পাওয়া যাবে এবং বিভিন্ন জায়গায় দালালদের খপ্পরে পড়ার সম্ভাবনাও কম হবে। যাত্রী ছাউনিতেই মানি চ্যেঞ্জার ছিল। সেখান থেকেই ভাল দামে সব নয় কিছু ডলার ভাঙিয়ে নিয়েছিলাম। শ্যালক বলেছিল বেনাপোল থেকে বাস বাদ দিয়ে ট্যাক্সি ক্যাবে করে কলকাতা চলে আসতে। আড়াই হাজার রুপি ভাড়া নিলেও দুই ঘন্টার মধ্যে চলে আসা যাবে। কিন্তু কিছুদূর হাঁটার ভয়ে আমরা বাসে করে প্রায় চার ঘন্টায় সেই পথ পাড়ি দিলাম। সীমান্ত থেকে একটা মোবাইল সিম কিনে নিয়েছিলাম। পথে গোগল ম্যাপ এ অবস্থান চেক করতে করতে এলাম।
মির্জা গালিব স্ট্রীট 

কিন্তু যতই ভাব দেখাই না কেন দালালেরা ঠিকই বুঝে গেল আমরা আগন্তুক। ভাল হোটেলের প্রস্তাব নিয়ে তারা আমাদের পিছু নিলো। রাস্তার দুই পাশে অসংখ্য হোটেলের বিলবোর্ড চোখে পড়ছে। সবগুলো চেক করা সম্ভব নয়। মারকিউস স্ট্রীট, সদর রোড, মির্জা গালিব স্ট্রীট, চৌরঙ্গী লেন কাটাকুটি খেলার ছকের মতো বিছিয়ে আছে। আর এগুলোর ধার ধরেই রয়েছে স্বল্প মূল্য থেকে মোটামুটি মূল্যের হোটেলগুলো। সাধারণত বাংলাদেশ ও জাপান থেকে আগত পর্যটকরাই এগুলোর প্রধান খদ্দর বলে মনে হল।  মির্জা গালিব স্ট্রীট আড়াআড়ি ভাবে পার হয়ে আর কিছুদূর সামনে গিয়েই দ্বিতীয় হোটেলটি পাওয়া গেল। এটার চেহারা ছুরত আধুনিক। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত লাউঞ্জে ওদের অপেক্ষা করতে দিয়ে আমি রুম দেখতে গেলাম। আমাদের প্রয়োজন ছিল চারজন থাকা যাওয়ার মত ফ্যামিলি স্যুইট, অথবা সংলগ্ন দুটি রুম। যে স্যুইটটি দেখাল তাতে একটা ডাবল বেড থাকলেও আর দুজন থাকতে হবে সোফা খুলে বেড বানিয়ে। এভাবে থাকা যায় না। অগত্যা লটবহর ও তাদেরকে লাউঞ্জে রেখে আমি বের হলাম আর একটি হোটেলের সন্ধানে। এবার গোবেচারা  চেহারার একজন দালালকে আমার চাহিদার কথা বললাম। সে আমাকে আশ্বাস দিয়ে বলল, কোন চিন্তা নেই সে রকম হোটেল আছে। সে একটু কাছেই আমাকে মির্জা গালিব স্ট্রীটের একটি হোটেলে নিয়ে গেল। হোটেলটির গ্যাট আপ এবং সংলগ্ন দুটি কক্ষ আমার পছন্দ হল। দুটোতেই ডাবল বেড, সোফা, বত্রিশ ইঞ্চি এলইডি টিভি, রেফ্রিজারেটর, পরিষ্কার বাথরুম ও ফ্রি ওয়াইফাই রয়েছে। ভারা একটু চড়া। দুটোয় ছয় হাজার রুপি। দর কষাকষি করে সেটা চার হাজারে সাব্যস্ত হোল। সাথে ব্রেকফাস্ট ফ্রি। আমার ছেলেমেয়েরা মুটামুটি সন্তুষ্ট।

কলকাতায় আসার পূর্বে ইন্টারনেট ঘেঁটে যে হোটেলগুলো টার্গেট করেছিলাম সেগুলোর ছবি ও ভাড়ার সাথে বাস্তবের কোন মিল নেই। সুহৃদদের পরামর্শও আপনার চাহিদার সাথে মিলবে না। তাই এখানে এসেই সরেজমিনে পছন্দ করাই ভাল। আর দর কষাকষি করে আপনি অনেক কম ভাড়াতেই পেয়ে যাবেন। হোটেল রয়েছে অসংখ্য। না পাওয়ার কোন ভয় নেই। বার ঘন্টা বাসে জার্নি, এর সাথে ঘন্টা খানেক ইমিগ্রেশনের ঝামেলার পর শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে  গরম ঠাণ্ডা পানির ঝরনা এবং নরম গদি ওয়ালা সফেদ বিছানা। পাঁচ তাঁরা হোটেল না হলেও আমাদের জন্য এর চেয়ে সুখ আর কাকে বলে?


সোমবার, ২২ জুলাই, ২০১৩