বৃহস্পতিবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০১২

মুক্তমনাদের নৈতিকতার উৎস


যারা ধর্মে বিশ্বাস করে না, বলা হয়ে থাকে, তাদের কোন নৈতিকতাও থাকে না। তাদের মধ্যে থাকে না কোন মানবতা-বোধ। সমাজে তারা পশুর আচরণ করে বেড়ায়। তারা সমাজে বসবাসের অনুপযুক্ত। মানুষ হিসেবে যে সমস্ত মানবিকতা একজন মানুষের থাকা প্রয়োজন ধর্মে অবিশ্বাসীদের তা থাকে না। অর্থাৎ যেন ধর্মহীন মানুষ, মানুষ নয়, পশু।

অভিযোগগুলি পুরাপুরি মিথ্যা নয়! কারণ মানুষেরা প্রকৃত পক্ষে মানব পশু। মানুষের সচেতন অসচেতন মনে মননে আচার আচরণে মানব পশুর বিধি ব্যাকরণ কাজ করছে। সে অন্যান্য পশুদের মতই সকাল সন্ধ্যা খাদ্য ও আশ্রয়ের জন্য খেটে চলছে। পশুদের মতই সে যৌন সঙ্গম করছে। পশুদের মতই সে ভয় পেলে পালিয়ে যাচ্ছে। অন্যকে দুর্বল পেলে তার উপর হম্বি তম্বি করছে। আবার পশুদের মতই দলবদ্ধ বা সামাজিক ভাবে বসবাস করছে। সতীর্থদের প্রতি তার রয়েছে প্রেম, অনুরাগ ইত্যাদি। মানুষ মানব পশু বলেই তাদের মধ্যে এই সমস্ত সার্বজনীন আচরণ ও নৈতিকতা কাজ করছে।  মানব প্রজাতির এই সমস্ত সার্বজনীন আচরণ ও নৈতিকতার অধিকাংশই অন্যান্য পশুদের আচরণের সাথে মিল থাকলেও মানব প্রজাতি হিসেবে তার নিজস্ব কিছু পৃথক সংযোগও রয়েছে। অর্থাৎ মানব পশু হিসেবে তার নিজস্ব কিছু নৈতিকতা তো অবশ্যই রয়েছে। এই নৈতিকতা কাজ করে তার সহজাত প্রবৃত্তি থেকে। এর সাথে যোগ হয়েছে সে যে সমাজে বাস করে সেই সমাজ বা গোষ্ঠীর দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠিত প্রথা থেকে। কিছু আসে রাষ্ট্র থেকে। কিছু আসে আধুনিক মানুষ হিসেবে যৌক্তিক গ্রহণ বর্জনের মাধ্যমে।

এই সামাজিক মানুষদের মধ্যে থেকে যারা ধর্ম করে তাদের নৈতিকতায় যুক্ত হয়েছে ধর্মীয় বিধি নিষেধ, ধর্মীয় নৈতিকতা। ধর্ম ভেদে এই নৈতিক মূল্যবোধগুলো ভিন্ন হতে পারে। এক ধর্মের দৃষ্টিতে যেটা নৈতিক অন্য ধর্মের দৃষ্টিতে সেটাই হয়তো অনৈতিক। সুতরাং এক ধর্মের লোকদের দৃষ্টিতে অন্য ধর্মের লোকদের অনেক কার্যক্রম অনৈতিক মনে হতেই পারে। কিন্তু সবারই রয়েছে নৈতিকতা। নৈতিক মূল্যবোধ বাদ দিয়ে কেও সমাজে বাস করতে পারে না। যারা কোন নির্দিষ্ট ধর্মে বিশ্বাসী নয়, তাদের মধ্যে রয়ে যায় সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, বিশ্ব মানবিক, প্রাকৃতিক নৈতিক মূল্যবোধ। সুতরাং যারা ধর্মহীন তাদের ধর্মীয় নৈতিকতার অবশ্যই অভাব রয়েছে কিন্তু তাদের রয়েছে মানব প্রজাতির বিশ্ব নৈতিকতা বা প্রাকৃতিক সার্বজনীন নৈতিক মূল্যবোধ। আর যারা ধর্মে বিশ্বাসী তাদের নৈতিকতা অনেক ক্ষেত্রেই সংকীর্ণতা দোষে দুষ্ট।  তবে ধর্মীয় নৈতিক মূল্যবোধগুলোও আকাশ থেকে আসেনি। সেগুলো মানুষেরই তৈরি। তাই মানব প্রজাতির বিশ্বজনীন নৈতিকতার প্রতিফলন এতে রয়েছে। কিন্তু অন্যান্য ধর্ম থেকে নিজস্ব স্বকীয়তা রক্ষা করতে গিয়ে কিছু কিছু ধর্ম এমন কিছু নৈতিকতা গ্রহণ করেছে যা বিশ্ব মানবতার সাথে সাংঘর্ষিক। আবার রাষ্ট্রীয় আইনে সংরক্ষিত নৈতিকতাও বিশ্বজনীন নয়। অন্যান্য রাষ্ট্রের মানুষের প্রতি তাদের আচরণ প্রায়শই বৈষম্যমূলক। এমনকি নিজ রাষ্ট্রের বিভিন্ন শ্রেণীর নাগরিকদের প্রতিও নৈতিক আচরণ বিভিন্ন হয়ে থাকে। এভাবে মানব সমাজ যত গোষ্ঠী, জাতি, সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়েছে ততই তাদের নৈতিক মূল্যবোধ বিশ্বজনীনতা হারিয়েছে।

প্রকৃতিবাদ প্রকৃতি থেকে, বস্তুজগৎ থেকে জ্ঞান আহরনের কথা বলে। যা কিছু বস্তু জগতের কোন কিছুকে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত করে সেগুলোই বাস্তব জগতের অন্তর্ভুক্ত। প্রকৃতি জগতের এই প্রভাবিত-করণ বিশৃঙ্খল কিছু নয়। সব কিছুই নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম নীতি মেনে পরস্পর পরস্পরকে প্রভাবিত করছে। এই নিয়ম নীতি গুলোকে অনুমিত, পর্যবেক্ষণ, নিরীক্ষণের এবং পুনঃ পুনঃ যাচাই করণের মাধ্যমে আবিষ্কার করাই হল জ্ঞান আহরণের পদ্ধতি। বস্তু জগত  বিশ্ব ব্রন্মান্ড সৃষ্টির আদি পর্ব থেকে অর্থাৎ অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বের আবির্ভাবের পর থেকে শক্তি, তরঙ্গ, কণা, তাপ ও গতির পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ায় পর্যায়ক্রমিক ভারসাম্যের ফল। পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া, ফল স্বরূপ পর্যায়ক্রমিক ভারসাম্য বিশ্ব ব্রন্মান্ডকে বিশৃঙ্খলা থেকে শৃঙ্খলা প্রদান করেছে। পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া, ফল স্বরূপ পর্যায়ক্রমিক ভারসাম্যই প্রাকৃতিক নীতি।  পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া একটি ভারসাম্য অবস্থার অভ্যন্তরে সর্বদা চলমান প্রক্রিয়া। এর ফলেই একটি ভারসাম্য অবস্থা থেকে আর একটি ভারসাম্য অবস্থায় উত্তরণ ঘটে। এটাই প্রগতি। একজন প্রকৃতিবাদীর কাছে এই পর্যায়ক্রমিক ভারসাম্যের প্রাকৃতিক নীতিই মানুষের নৈতিকতার উৎস।

পাহাড়, নদী, জল, জীব বৈচিত্র্যের লীলা ভূমি এই পৃথিবীর বর্তমান এই রূপ ইকো-ভারসাম্যের ফসল। সমস্ত জীব জগতের মধ্যে পারস্পরিক ও ক্রমাগত ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার ফলেই তাদের বর্তমান এই ভারসাম্য। বেঁচে থাকার জন্য যেমন রয়েছে পারস্পারিক প্রতিযোগিতা, তেমনি রয়েছে পারস্পারিক সহযোগিতা। একজনের বেঁচে থাকা নির্ভর করছে আর একজনের বেঁচে থাকার উপর। এখানে কেউ কারো হুমকি স্বরূপ নয়।

লক্ষ লক্ষ বছরের বিবর্তনিয় ইতিহাসে প্রাণী জগতের বিভিন্ন প্রজাতি সমাজবদ্ধ ভাবে বসবাস করে আসছে। ন্যূনপক্ষে তারা তৈরি করছে যৌন বন্ধন। তাদের পারস্পারিক সামাজিক সহযোগিতাই প্রতিযোগিতা মূলক প্রতিকুল পৃথিবীতে টিকে থাকতে সাহায্য করেছে। আন্ত প্রজাতি নির্ভরতা এবং পারস্পরিক সহনশীলতাও টিকে থাকার ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করছে। তাদের এই আচরণ সহজাত। নৈতিক বিধিমালা হিসেবে এটি কোথাও লিখিত নেই। কোনরূপ ভয় থেকে বা পুরস্কারের লোভে তারা এই আচরণ করছে না। এই আচরণ হচ্ছে প্রজাতির স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিক আচরণ।

যা তার জন্য ভাল সেদিকে আকর্ষিত হওয়া এবং যা কিছু তার জন্য খারাপ সেদিকে বিকর্ষিত হওয়া প্রজাতির ধর্ম। আদি এককোষী জীব থেকে আরম্ভ করে বহুকোষী জটিল জীব পর্যন্ত প্রজাতির অনেকেই আলোর প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং অন্ধকার থেকে দূরে সরে যায়। আবার অনেকের ক্ষেত্রে এর উল্টোটাও ঘটে। প্রতিটি প্রাণী শিকারের প্রতি আকৃষ্ট হয় কিন্তু শিকারি থেকে পালিয়ে যায়। আবার অনেক সময় নিজেদের মধ্যে সহযোগিতার মাধ্যমে একজোট হয়ে উল্টো শিকারিকে ভয় পাইয়ে দেয়। নিজ প্রজাতির মধ্যে তারা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হয়। অধিকাংশ প্রজাতি দলগত ভাবে থাকতে ভালবাসে অর্থাৎ দলের প্রতি তাদের স্বভাবগত আকর্ষণ রয়েছে। অনেক তৃণভুজি প্রজাতি আবার অন্যান্য প্রজাতির সাথে একই চারণ ভূমি শেয়ার করে থাকে। পরস্পরের প্রতি এই যে সহনশীলতা এগুলো প্রজাতির আচরণগত বৈশিষ্ট্য।

প্রকৃতি জগতে সকল প্রজাতি পরস্পরের প্রতি বিধ্বংসী নয় বরং সহনশীল। বেঁচে থাকার জন্য যতগুলো শিকারের প্রয়োজন এর বাইরে অতিরিক্ত খুন করা হিংস্র প্রজাতির আচরণেও অনুপস্থিত। শিকারি প্রাণীগুলো নিজের টেরিটরি রক্ষার জন্য প্রথমে ভয় দেখাবে, তারপর আক্রমণ করবে। এই আক্রমণও বেশীরভাগ ক্ষেত্রে শক্তি প্রদর্শনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। অন্যদিকে একজনের টেরিটরিতে অন্য আরেকজন পারতপক্ষে অনুপ্রবেশ করে না।  এই নিয়ম কানুনগুলো প্রাণী জগতের মধ্যে সহজাত।

প্রাণী জগতে যৌন প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে যতটুকু আক্রমণাত্মক মনোভাব দেখা যায় সেটাও শক্তি প্রদর্শনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে এবং আলফা পুরুষ বা আলফা স্ত্রীর সাথে চ্যালেঞ্জ-কারীর মধ্যেই চলে এই প্রতিযোগিতা। একবার এই প্রতিযোগিতার ফলাফল নির্ধারিত হয়ে গেলে পুনরায় সহনশীলতা ফিরে আসে। প্রাণী জগতে প্রতিশোধ পরায়ণতা, হিংসা, বিদ্বেষ, জিঘাংসা ইত্যাদি বেঁচে থাকা বা বংশ বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় নয় এইরূপ কোন বিধ্বংসী মনোভাবের অস্তিত্ব নেই।

জড় বা জীব প্রকৃতির সর্বত্রই ভারসাম্য বিদ্যমান বা ভারসাম্যের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। পরস্পরকে জায়গা করে দেয়ার রীতি বা পরস্পরের প্রতি সহনশীলতার নীতি বা পরস্পরের প্রতি নির্ভরতার নীতি  প্রকৃতির সর্বত্রই বিরাজমান। জড় বা জীব প্রকৃতির এই রীতি নীতির জন্যই প্রকৃতির এই স্থিতিশীল অস্তিত্ব।  রাতের অন্ধকারে আমরা যখন খোলা আকাশের দিকে তাকাই আমরা দেখতে পাই শান্ত প্রশান্তিময় এক তারকারাজির জগত। সংঘর্ষহীন ভাবে পরস্পর পরস্পরের প্রতি নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে সর্বদা ঘূর্ণয়নমান। পৃথিবীর বুকে আমরা দেখতে পাই পাহাড়, নদী, জল, বৃক্ষরাজির অপূর্ব সহবস্থানের দৃশ্য। প্রাণী জগতে বিভিন্ন প্রজাতির শান্তিময় সামাজিক কর্মকাণ্ড, আন্ত প্রজাতির পারস্পরিক সহনশীলতাময় সহাবস্থান, আদিবাসী বিভিন্ন মানব গোষ্ঠীর সহজ সরল গানে বাজনায় উল্লাসময় জীবন যাপন ইত্যাদি প্রকৃতির ইকো-ভারসাম্যের ফসল। এই ইকো-ভারসাম্যর মধ্যেই নিহিত রয়েছে প্রকৃতিবাদীদের নৈতিকতার উৎস। এর বাইরে কোন অলৌকিক উৎস থেকে অথবা গোষ্ঠী, জাতি, সম্প্রদায় বা শ্রেণীর স্বার্থ থেকে উৎসারিত নৈতিকতা অবশ্যই পক্ষপাত দোষে দুষ্ট হবে।

রবিবার, ১ জানুয়ারি, ২০১২

নতুন বছরের প্রত্যাশা


জীবন থেকে আর একটি বছর হারিয়ে গেলো। আজ ২০১২ সালের প্রথম সকাল। ভোর বেলা উঠে পূব আকাশের দিকে তাকালাম। এখনো সূর্য উঠেনি। কিন্তু দিগন্তে তার আভা ছড়িয়ে আছে। কালচে নীল মেঘের ছোপ ছাপিয়ে আলোর দ্যুতি ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। সেই আলোতে জরিয়ে রয়েছে শীতের কুয়াশা। জীবনে মাত্র বাহান্ন বার পেয়েছি বছরের এমন প্রথম ভোর! গভীর রাতের ভোরে ঘুম ভেঙ্গে গিয়ে আর ঘুম আসছিলো না। বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে অর্ধ-চেতন মন কেবলই ভাবছিল এই বাহান্ন বছর জীবনে পৃথিবীতে আমার অস্তিত্ব কোথায়?

কোথাও নেই! কারণ আজ যদি আমার দেহের মৃত্যু ঘটে পৃথিবীতে আমার আর কোন অস্তিত্ব থাকবে না। অর্ধ-চেতন মনেই ভাবছিলাম, জীববিদ্যা অনুযায়ী আত্মা বলে তো কিছু নেই যা আমাকে পরকালের অনন্তকালের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আমার দেহের সমাপ্তির সাথে আমার মনেরও এখানেই সমাপ্তি।

ভাবছিলাম আমার মন তো আমার মস্তিষ্কে সর্বদা অনুরণন রত স্মৃতিগুচ্ছ ছাড়া আর কিছুই নয়। অর্থাৎ আমি হলাম আমার মস্তিষ্কে অনুরণন রত স্মৃতিগুচ্ছ। আমার মস্তিষ্কের মৃত্যু ঘটলে আমার স্মৃতিগুচ্ছও হারিয়ে যাবে যদি না এটা কোথাও কপি করে রাখি! আমার স্মৃতিগুচ্ছের তিনটি ড্রাইভ রয়েছে। একটি হল সি ড্রাইভ। যেটার স্মৃতিগুচ্ছ আমার দেহকে পরিচালনা করছে। আমার দেহের বিভিন্ন জৈব রাসায়নিক সিগনালকে গ্রহণ করছে, প্রসেস করছে এবং তারপর বিভিন্ন জৈব রাসায়নিক সিগনাল আধারে নির্দেশনা পাঠাচ্ছে। এই ড্রাইভের স্মৃতিগুচ্ছের অনুরণনের ফলে আমি সুখ, দুঃখ, ক্ষুধা, ক্ষোভ, হিংসা, বিদ্বেষ, রাগ, অনুরাগ, তাড়না, বাসনা ইত্যাদি অনুভূতিগুলো অনুভব করে থাকি, যা আমার একান্ত নিজস্ব সম্পদ।  দ্বিতীয় ড্রাইভটি মনে করি ডি ড্রাইভ। এর স্মৃতিগুচ্ছে রয়েছে আমার বাইরের জগত থেকে লব্ধ জ্ঞান এবং অন্যের স্মৃতিগুচ্ছের কপি। এর দ্বারা আমি নিজেকে সব সময় আপ টু ডেট রাখি। তৃতীয় ড্রাইভের স্মৃতিগুচ্ছে থাকার কথা আমার নিজস্ব উদ্ভাবন, রচনা, বানী, আবিষ্কার, সৃষ্টি যা অন্যের কাছে প্রয়োজনীয় মনে হয় এবং  যেগুলো তারা তাদের ডি ড্রাইভে কপি করে রাখে। বিশ্বের মনিষী-গন তাঁদের এই স্মৃতিগুচ্ছ স্থাপত্য, ভাস্কর্য, ক্যানভাস, পুস্তক, টেকনোলজি, হস্তশিল্প ইত্যাদিতে হার্ড কপি করে অথবা গান, কবিতা, বাণী, বচন ইত্যাদি উপায়ে বহু লোকের স্মৃতিগুচ্ছে সফট কপি করে রাখেন। এভাবে মনিষী-গন পৃথিবীতে অমর হয়ে থাকেন। কালক্রমে তাঁদের নাম কালের গর্ভে হারিয়ে গেলেও তাঁদের স্মৃতিগুচ্ছ সামাজিক মস্তিষ্কে অথবা হিউম্যান মস্তিষ্কে অথবা চূড়ান্ত রূপে জেনেটিক কোডে বেঁচে থাকে।

বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক নাকি সংরক্ষণ করা আছে। আমি জানি না মানুষের মস্তিষ্ক বাইনারী পদ্ধতিতে কাজ করে কিনা। যদি করে থাকে এবং আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের ফ্রিজ হয়ে যাওয়া স্মৃতিগুচ্ছ যদি কোনভাবে কোন কম্পিউটারে কপি করা যায় এবং সেগুলোকে যদি যথাযথ ভাবে সক্রিয় করা যায় তবে কেমন হয়? সেই কম্পিউটারটি হয়তো আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক অথবা মন হিসেবেই কাজ করবে!  আত্মা বা সেলফ যদি মস্তিষ্কের স্মৃতিগুচ্ছই হয়ে থাকে তবে সেটা হবে কম্পিউটার-ধারি আইনস্টাইন। অর্থাৎ বলা যাবে আইনস্টাইন তাঁর দেহ ছেরে কম্পিউটার ধারণ করেছেন! সেই কম্পিউটার রূপি আইনস্টাইনকে যদি বর্তমান যুগের উপাত্ত সরবরাহ করা হয় তাহলে হয়তো তিনি নতুন নতুন থিওরিও আবিষ্কার করতে পারবেন। বৈজ্ঞানিক থিওরি আবিষ্কারের জন্য হয়তো দেহ জাত অনুভূতির প্রয়োজন হয় না। তাই এখানে তাঁর দেহ না থাকলেও চলবে। এমনিতেই আমরা মনিষীদের ভাবনা বা স্মৃতিকেই গ্রহণ করে থাকি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনকে নয়। মনিষীরাও তাঁদের কাজ থেকে ব্যক্তিগত জীবনকে দূরে সরিয়ে রাখেন। বর্তমান যুগের বিখ্যাত মনিষী স্টিফেন হকিংসকে তো একজন মানুষ রূপি কম্পিউটারই বলা যায়। কারণ ব্যক্তিগত অনুভূতিগুলো বাদ দিলে বহির্বিশ্বের সাথে তার যোগাযোগ ঘটে যান্ত্রিক ইনপুট আউটপুট ডিভাইস দিয়ে।

অর্ধ-চেতন ঘুমের ঘোরে আমি দেখলাম আমার তৃতীয় ড্রাইভটি একদম শূন্য। অর্থাৎ দেহান্তরের পর পৃথিবীতে রয়ে যাওয়ার কোন উপায়ই আমার নেই। একটি দেহ জাত চাপা বেদনার অনুভূতি আমার ভিতর থেকে গলায় উঠে এলো। জানি এর মূল্য কারো কাছে নেই এবং আজ বাদে কাল এর মূল্য আমার কাছেও থাকবে না। মনের ভিতরে আকুলি বিকুলি করতে করতে মনে এলো আমার একটা ফেসবুক আইডি রয়েছে! সেটাই তো ভার্চুয়াল আমি! আমার সাথে বহির্জগতের যোগাযোগ হয় এই আইডির মাধ্যমে। এই আইডির মাধ্যমেই আমার নিজস্ব ভাবনা চিন্তা অনুভূতি, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ ঘটে। আমার ঠিকানা সর্বদা নেটে বিরাজ করে। এখানে যে কেউ আমাকে দেখতে পায়, যোগাযোগ করতে পারে। আমার স্মৃতিগুচ্ছের কিছুটা এখানে সংরক্ষিত আছে। আমার দেহান্তর ঘটলেও এই ভার্চুয়াল আমিতে আমি থেকে যাব। এখন এটাকে যদি আমার সংরক্ষিত চরিত্র ও জ্ঞান অনুযায়ী এমন একটা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সে পরিণত করা যায় যে সে নিজে নিজেই বহির্জগতের সাথে নিজের মতামত আদান প্রদান করতে পারে তাহলেই কিল্লা ফতে!
  নতুন বছরের ভোরে ভবিষ্যতের এই আশার আলো দেখতে পেয়ে আমি একটা স্বস্তিতে  পুনরায় ঘুমিয়ে পরলাম।